বাড়ছে প্রশিক্ষিত নারী কৃষকের সংখ্যা

প্রশান্তি ডেক্স ॥ সাহিদা বেগম একজন প্রশিক্ষিত নারী কৃষক। বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন- বিএডিসিএর চুক্তিবদ্ধ চাষি তিনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এসএমই কৃষক। বাড়ি থেকে বীজ বিক্রি করে ২০২০ সালে ৩ কোটি টাকা লাভ করেন তিনি। ফরিদপুরের কৃষক হলেও আজ জাতীয় পর্যায়ে সফল নারী কৃষক হিসেবে সাহিদা সবার গর্ব। শুধু সাহিদা বেগম নন, সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্লাপুরের সাহানারা বেগম আজ ফুল ও সবজি চাষ করে অনেককে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারাও তার সাফল্যের প্রশংসা করেছেন। সিলেটের দক্ষিণ সুরমার রুমী আক্তার হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করে সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন। এমন অনেক নারী আজ প্রশিক্ষণ নিয়ে কৃষিক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তবে এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহল বলছে, কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে ঠিকই। তারা প্রশিক্ষিত, দক্ষও বটে। তবে ভূমিতে নারীর অধিকার, মজুরিবৈষম্য, উত্পাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকায় নারীর সঠিক ক্ষমতায়ন হচ্ছে না। তাই আইন করে নতুন মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সম্প্রতি সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্লাপুরে কথা হয় সাহানারা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, ২০০০ সালে ঐ এলাকায় আসেন স্বামীর সঙ্গে। এলাকায় সবজি আর ফুল চাষের প্রচলন বেশি। তার নিজের কোনো জমি নেই। তাই অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে ৬ শতক জায়গায় ফুল আর ৬ শতক জায়গায় গম চাষ শুরু করেন। আর বর্তমানে তিনি সারা বছরই শাক-সবজি, গম আর গোলাপের চাষ করেন। সাহানারা জানান, শুরুতে তিনি একাই নিজের বর্গাজমিতে কাজ করেছেন। স্বামী আমীর হামজা অন্যের জমিতে কাজ করতেন। সংসার চালাতে তাদের অনেক কষ্ট হতো। আজ নিজেরা তো বটেই, এলাকার অনেক নারী-পরুষ তার জমিতে কাজ করছেন। নিজে বেশ কিছু বিষয়ে প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। কখন বীজ বুনতে হয়, কী করে পোকার হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য জৈব সার দিতে হয় এবং কীভাবে ‘সেক্স ফেরোমন ফাঁদ’ পেতে খেতের ক্ষতিকর পোকা নিধন করতে হয় এ সবই জানা। তিনি নিজে মাঠে কাজ করেন আর উত্পাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করেন তার স্বামী। বাড়ি থেকে তিনিও কিছু বিক্রি করেন। স্থানীয় কৃষি কর্মকতা মো. মোজ্জামেল হক জানান, তাদের প্রশিক্ষিত কৃষকের মধ্যে এখন নারীর সংখ্যা বাড়ছে। সাদুল্লাপুরে ৪০ জন পুরুষ কৃষক প্রশিক্ষণ নিলে ২০ জন নারী কৃষকও প্রশিক্ষণ নেন। তাঁরা বেশ ভালো করছেন।
‘কমন ইন্টারেস্ট গ্রুপে’ (সিআইজি) ৬০ জন প্রশিক্ষিত নারী কৃষক আছেন। মোবাইল ফোনে কথা হয় ফরিদপুর পৌরসভার গোবিন্দপুর গ্রামের সাহিদা বেগমের সঙ্গে। বাড়ি থেকেই পেঁয়াজের বীজ বিক্রি করেন তিনি। ফরিদপুরের বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা সাহিদার বীজ কিনতে আসেন। সাহিদা জানান, শাশুড়ি তাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। তাকে দিয়ে ফসল তোলাসহ অনেক কাজ করাতেন। একসময় তাদের আলাদা করে দেওয়া হয়। জীবিকার তাগিদে তখনই নিজেরা কৃষিকাজ করতে শুরু করেন। স্বামী কলেজে পড়াশোনা করে তার কাজে সহযোগিতা করতেন। একসময় স্বামীর ব্যাংকে চাকরি হয়। তখন তিনিই কৃষিকাজটা ধরে রেখেছেন। ২০০৪ সালে পাশের এক চাষিকে দেখে পেঁয়াজের বীজ চাষ শুরু করেন সাহিদা। প্রথম ৪০ শতাংশ জমিতে দুই মণ বীজ পান। ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। দেখেন এর চাহিদা অনেক, লাভও ভালো। এভাবেই এগিয়ে চলা। সাহিদা জানান, গত বছর তিনি ৩০ একর জমিতে পেঁয়াজ বীজ চাষ করে ২০০ মণ বীজ পান, যা বিক্রি করেন ৪ কোটি টাকায়। লাভ হয় ৩ কোটি টাকা। জমির মধ্যে বেশির ভাগই বর্গা জমি। জানালেন, অনেকেই তাকে দেখে পেঁয়াজবীজ চাষে উদ্বুদ্ধ হন। তিনি নানা রকম প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আগে বস্তা ভর্তি করে বীজ রাখতেন। কেউ চাইলে বস্তা খুলে মেপে দিতেন। এতে বীজের ক্ষতি হতো। প্রশিক্ষণই তাকে শেখায় প্যাকেট করে বীজ রাখলে বীজের ক্ষতি কম হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপ নারী কৃষককে এগিয়ে যেতে সহায়তা করছে। আমাদের প্রতিটি প্রশিক্ষণে ৩০ শতাংশ নারী কৃষককে অন্তর্ভুক্ত করার নিয়ম করা হয়েছে। তার পরও কৃষি শ্রমিকদের মজুরিবৈষম্য আছে বলে জানান সাদুল্লাপুরের কৃষিশ্রমিক সর্দার মনি নারী। ষাটোর্ধ্ব মনি জানান, বংশপরম্পরায় তারা কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। নিজের জমি নেই। সংসার চালাতে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। অনেক সময় স্বামীই বেশি আয় করেন। মনি ২০ জন নারী শ্রমিককে নেতৃত্ব দেন। কারো নারী শ্রমিক লাগলে জোগান দেন।
কেন এখনো মজুরিবৈষম্য—এমন প্রশ্নের জবাবে সাভার কৃষি কমকর্তা নাজিয়াত আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, অনেকেই মনে করেন, পুরুষের শক্তি বেশি বলে কাজ বেশি করে। তাই মজুরি বেশি। কিছু কুসংস্কার ও ধর্মীয় বিষয় এখনো নারীদের এগিয়ে চলার পথে বৈষম্য সৃষ্টি করে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম বলেন, মুজিব জন্মশত বার্ষিকীতে ১০০ পুষ্টি বাজার করছে সরকার। এ উপলক্ষ্যে ৫ লাখ বাজার করা হবে। সেখানে ৫ লাখ নারীকে যুক্ত করা হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশ ইত্তেফাককে বলেন, ঘর ছেড়ে কাজে যোগ দেওয়া প্রথম ধাপ। এটি পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বাজার অর্থনীতিতে দুই দিকের তাগিদ থেকে সৃষ্টি হয়, যা নারী শ্রমবাজারে যুক্ত করে শ্রমবাজার অর্থনীতি। কিছু ব্যতিক্রমী নারী দক্ষতা অর্জন করে কাজে পারদর্শিতা দেখিয়ে এগিয়ে যায়, এটা অর্থনৈতিক অগ্রগতি। কিন্তু সাংস্কৃৃতিক ও আইনগত স্বীকৃত অগ্রগতি সহজে অর্জিত হয় না। এটি অর্জিত হতে হলে রাষ্ট্রকে আইন করতে হয়। পাঠ্যসূচিকে নতুন ভ্যালু দিয়ে পরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে মানসিকতা তৈরি করতে হয়। নানা রকম সাংস্কৃৃতিক আয়োজন করে মূল মানসিকতার পরিবর্তন করতে হয়। বাংলাদেশে প্রথম ধাপ অর্জিত হলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে আটকে আছে। নারীর নিজেকে ও রাষ্ট্রকে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.