নিত্যপণ্যের চড়া দামের মধ্যে বাড়ানো হলো জ্বালানির দরও

প্রশান্তি ডেক্স ॥ ডিজেলের দাম বাড়ানোর পরই বাসভাড়া বাড়িয়ে দিলেন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বাসমালিকেরা। এ রুটে সাধারণ বাসের ভাড়া ছিল জনপ্রতি ৩৬ টাকা, যা ১৪ টাকা বাড়িয়ে গত বৃহস্পতিবার ৫০ টাকা করা হয়েছে। সরকার গত বুধবার দিবাগত রাতে ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে দেয়। বৃদ্ধির হার ২৩ শতাংশ। ওদিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বাসমালিকেরা ভাড়া বাড়িয়েছেন ৩৯ শতাংশ। যাত্রীরা গত সকালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বাস কাউন্টারে গিয়ে ভাড়া নিয়ে ক্ষোব জড়ান। তবে কাউন্টারের কর্মীরা বলছিলেন, ভাড়া না বাড়িয়ে তাঁদের কিছু করার নেই। সব বাস কোম্পানিই যেহেতু ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে, সেহেতু যাত্রীদেরও কিছু করার ছিল না।
অসহায় যাত্রীদের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী লোকমান আহমেদ বলেন, সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে, কিন্তু বাসভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তাহলে পরিবহনমালিকেরা কীভাবে ইচ্ছেমতো জনপ্রতি ১৪ টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় করেন? এদিকে সরকারিভাবে ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে গত শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সারা দেশে গণপরিবহন ও পণ্যবাহী যানবাহন বন্ধ থাকবে বলে এ খাতের মালিক-শ্রমিকেরা জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়নি। জেলা পর্যায় থেকে জানানো হয়েছে। মালিকেরা বলছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যমান ভাড়ায় যানবাহন চালিয়ে পোষানো যাচ্ছে না।
বিশ্ববাজারে দর যখন কম ছিল, তখন জ্বালানির দাম কমানো হয়নি। তাহলে এখন বাড়ানো হলো কেন? এম শামসুল আলম, জ্বালানি উপদেষ্টা, ক্যাব
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, জ্বালানি তেল হলো একটি ‘কৌশলগত পণ্য’। তেলের দাম বাড়লে তা সরাসরি মানুষের যাতায়াত খরচ বাড়িয়ে দেয়। পরোক্ষ ভাবে কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও সব পণ্যের পরিবহন ব্যয় বাড়ে। যার প্রভাব পড়ে পণ্যের দামে। ফলে আগামী দিনগুলোতে সব ধরনের পণ্যের দাম কিছু কিছু বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শুধু ডিজেল নয়, গত বুধবার মধ্যরাতে বাড়ানো হয়েছে কেরোসিনের দামও, প্রতি লিটারে ১৫ টাকা। বাড়ানো হয় ফার্নেস অয়েলের দাম, লিটারে ৩ টাকা। ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় বেড়ে যাবে। সরকার ভর্তুকি না দিলে বাড়বে বিদ্যুতের দামও। এদিকে বেসরকারি খাতের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দামও গতকাল বেড়েছে। ১২ কেজির সিলিন্ডারে বেড়েছে ৫৪ টাকা। জ্বালানির দাম এমন সময় বাড়ল, যখন বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, মুরগির মাংস, সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেশি। করোনাকালে মানুষের আয় কমেছে। বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসি ও বিআইজিডি জরিপের তথ্য তুলে ধরে জানায়, দেশে করোনাকালে নতুন দরিদ্র হয়েছে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জ্বালানির দাম বাড়লে মূল্যস্তরে প্রভাব পড়ে। এর কারণে স্থির আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, সমস্যা হলো, দেশে জ্বালানি তেলের কারণে যতটুকু খরচ বাড়ে, তার চেয়ে ভাড়া অনেক বেশি বেড়ে যায়।
জ্বালানি তেলের ওপর যে শুল্ক আছে, সেখানে ছাড় দিয়ে দাম আরেকটু কম হারে বাড়ানো যেত বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, অন্য নিত্যপণ্যে শুল্ক ছাড় দিয়ে এবং কৃষকের জন্য ভর্তুকি বাড়িয়ে নেতিবাচক প্রভাব সীমিত রাখা যেতে পারে। দাম বাড়ানোর একদিন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্র বলছে, বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ টন। এর মধ্যে ডিজেলের চাহিদা ৫০ লাখ টন, যার ৪০ লাখ টন আমদানি করা হয়। ডিজেলের মোট চাহিদার ৬৩ শতাংশ ব্যবহৃত হয় পরিবহন খাতে। আর সেচকাজে ব্যবহৃত হয় ১৬ শতাংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ২৬ শতাংশ ফার্নেস অয়েল ও ৬ শতাংশ ডিজেলচালিত কেন্দ্র। গ্যাসের সংকট থাকায় এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়মিত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম যে লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়েছে, তা কার্যকর হয় গতকাল (বুধবার দিবাগত রাত ১২টার পর)। বিকেলে আসে ফার্নেস অয়েলের দাম লিটারপ্রতি ৩ টাকা বাড়ানোর খবর। বিপিসি নতুন দর নির্ধারণ করেছে প্রতি লিটার ৬২ টাকা। বিপিসির পরিচালক (অপারেশনস ও পরিকল্পনা) সৈয়দ মেহদী হাসান বলেন, বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে। বিপিসি পাঁচ মাস ধরে লোকসান দিচ্ছে। তাই দাম বাড়ানো হয়েছে।
বেসরকারি খাতে ১২ কেজি সিলিন্ডারের এলপিজির দাম মূল্য সংযোজন করসহ (মূসক/ভ্যাট) ১ হাজার ২৫৯ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৩১৩ টাকা করা হয়েছে। নতুন দর কার্যকর হয়েছে। সঙ্গে বেড়েছে গাড়িতে ব্যবহৃত এলপিজির (অটো গ্যাস) দাম। নতুন দর প্রতি লিটার ৬১ টাকা ১৮ পয়সা, যা আগে ছিল ৫৮ টাকা ৬৮ পয়সা।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি, সিপিবিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁওয়ে সাংবাদিকদের বলেন, একদিকে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সে সময় আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো।
অঘোষিত ধর্মঘট
পরিবহন সূত্রগুলো বলছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর পরিবহন খাতের বিভিন্ন সংগঠন নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে। এসব বৈঠক থেকে ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার আগপর্যন্ত পরিবহন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঢাকায়ও বাস চলবে না বলে মালিকেরা বলছেন। বাসমালিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ডিজেলের দাম বাড়ানোয় বাস চালিয়ে লোকসান গুনতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন জেলার পরিবহনমালিকেরা বাস না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পণ্যবাহী যানবাহন মালিকদের সংগঠন ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্যাংকলরি, প্রাইম মুভার মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান বলেন, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পণ্য পরিবহনে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার জ্বালানি তেল খরচ হয়। ডিজেলের দাম বাড়ায় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকার জ্বালানি খরচ বেড়ে যাবে।
পরিবহন খাতের সূত্র বলছে, ভাড়া সমন্বয়ের আশ্বাস পেলে ধর্মঘট তুলে নেওয়া হবে। দুই–একদিনের মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠক হতে পারে বলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকনেতারা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানায়। চিঠি পেয়ে বিআরটিএ রোববার বেলা ১১টায় বৈঠক ডেকেছে। সংস্থাটির চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, বাস ভাড়ার বিষয়ে রোববারের বৈঠকে আলোচনা হবে। এর মধ্যে ধর্মঘট অব্যাহত রাখার কোনো মানে হয় না।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি, গ্রিন ক্লাব অব বাংলাদেশ ও উন্নয়ন ধারা ট্রাস্ট ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনগুলো বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপ্রার্থী ও সরকারি চাকরিপ্রত্যাশীসহ সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে হঠকারী এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে। সাত বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা
জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, এর আগে সর্বশেষ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয় ২০১৩ সালে। মাঝে ২০১৬ সালে দাম কিছুটা কমিয়েছিল জ্বালানি বিভাগ। অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম কম থাকায়, বিপরীতে দেশে ততটা না কমিয়ে সর্বশেষ সাত বছরে বিপিসি প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। পাঁচ মাস লোকসান দিয়ে ডিজেল-কেরোসিনের দাম এক লাফে প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়।
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে দর যখন কম ছিল, তখন জ্বালানির দাম কমানো হয়নি। তাহলে এখন বাড়ানো হলো কেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published.