তারেক মাহমুদ ॥ জন্মগতভাবেই কি দুটি দিক দিয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশের মানুষ? একটা হলো শারীরিক শক্তি, আরেকটি ধৈর্য। আগেই বলে রাখা ভালো, প্রশ্নটা তোলা হচ্ছে ক্রিকেট খেলাকে মাথায় রেখে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের কথাই ধরুন। চার-ছক্কার এই খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা যে রকম বাহুবলী শট খেলতে পারেন; সেই সামর্থ্য কি আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের? সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর সদ্য শেষ হওয়া পাকিস্তান সিরিজেও এটা ভালোভাবেই প্রমাণিত যে বাংলাদেশ দলে ‘পাওয়ার হিটার’ নেই। ধৈর্যের খেলা টেস্ট ক্রিকেটেও বড় অধৈর্য দলটা। ধরে খেলার মধ্যেই যে সাদা পোশাকের ক্রিকেটের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য, সেটা জেনেও তাই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা মানেন না। ধৈর্য ধরার মানসিকতাটাই অনুপস্থিত তাঁদের মধ্যে। বাংলাদেশের সাদা ক্রিকেট তাই রঙিন হয় না।
ধৈর্য ধরার মানসিকতাটাই অনুপস্থিতফাইল ।
পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই টেস্টে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং দেখে সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেনের পর্যবেক্ষণও সেটাই বলে, ‘আমাদের ব্যাটসম্যানদের ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। রান করতে না পারায় একধরনের আতঙ্ক ভর করেছে ওদের মধ্যে। ঢাকা টেস্টের প্রথম ইনিংসে মুমিনুলের রানআউটটা মনে হয়েছে সেই আতঙ্কের কারণেই।’ ক্রিকেটের তিন সংস্করণের মধ্যে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতেই বাংলাদেশ বেশি পিছিয়ে। এই দুই সংস্করণের মধ্যে কোনটি বাংলাদেশ বেশি খারাপ খেলে, তা একটা প্রশ্ন বটে। ওয়ানডেতেও বাংলাদেশ যে খুব বড় দল হয়ে গেছে, তা নয়। তবু অন্তত ঘরের মাঠে এই সংস্করণের ক্রিকেটে বাংলাদেশকে এখন সব দল সমীহ করে। গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে এটাকেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলতে পারেন।
তাহলে টি-টোয়েন্টি ও টেস্ট ক্রিকেটে কি বাংলাদেশ কখনোই ভালো খেলবে না? অবশ্যই খেলবে, যদি এই দুই সংস্করণের ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সঠিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকে, যে পরিকল্পনার কথা উপলক্ষবিশেষে শুধু শোনাই যায়, দেখা তেমন যায় না। সবকিছুই যেন সাময়িক ফল লাভের আশায়। টেস্ট আর টি-টোয়েন্টির উন্নতি আটকে আছে এই জায়গাতেই।
বাংলাদেশের টেস্ট ব্যাটিং এখনো প্রশ্নবিদ্ধছবি
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট নিয়ে প্রতিবছর অনেক হইচই হয়। তাতে লাভ একটিই হয়েছে, ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফি বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক। কিন্তু দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটের জন্য দেশের আনাচকানাচ থেকে প্রতিভা তুলে আনার উদ্যোগ নেই। দৃষ্টিসীমায় থাকা ক্রিকেটারদের নিয়ে বিভাগীয় দলগুলোর জন্য জাতীয় নির্বাচকেরাই দল গঠন করে দেন। দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের দুই আসর জাতীয় লিগ আর বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের উইকেট আজও পেস–সহায়ক হয়ে ওঠেনি, যেখানে খেলে ব্যাটসম্যানরা টেস্টের জন্য প্রস্তুত হবেন। দলগুলোর অনুশীলনের জন্যও নেই পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধা। কয়েক বছর ধরে অবশ্য বিসিবি থেকে নির্দেশনা থাকে উইকেটে ঘাস রাখার। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে পলির পরিমাণ বেশি বলে উইকেটের মাটি পানি ধরে রাখে, উইকেট থাকে নরম। ঘুরেফিরে কিছু মাঠেই খেলা হয় বলে উইকেট বিশ্রামও পায় কম। আর কিউরেটরদেরও সবার দক্ষতা সমান নয় যে চাহিদামাফিক উইকেট বানিয়ে দেবেন। সব মিলিয়েই বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের কন্ডিশনটা এখনো আদর্শ হয়ে ওঠেনি।
ঘরোয়া ক্রিকেটে সত্যিকারের ফাস্ট বোলারের অভাব আছে
এমন উইকেটে বাংলাদেশের কম শক্তির পেস বোলাররা পারেন না গতি আর বাউন্সের ঝড় তুলতে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বিদেশি পেসার খেলানোর নিয়মটা কাজে লাগলে ব্যাটসম্যানরা হয়তো কিছু গতিময় পেসার সামনে পেতেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দুজন বিদেশি খেলোয়াড় নিবন্ধন এবং একজন খেলোয়াড় খেলানোর সুযোগ থাকলেও গত কয়েক বছরে কোনো দলই বিদেশি খেলোয়াড় আনায় আগ্রহ দেখায়নি। পাকিস্তানের পেসারদের বাউন্সারের সামনে ইয়াসির আলী ও সাইফ হাসানের দুর্বলতা বেরিয়ে পড়ার কারণ এটাই যে তাঁরা এ ধরনের বল খেলে অভ্যস্ত নন। গাজী আশরাফ অবশ্য এখানে কোচেরও ব্যর্থতা দেখেন, ‘জাতীয় দলের কোচ খেলোয়াড়দের টেস্টের জন্য প্রস্তুত করতে আলাদা সময় দেন বলে মনে হয় না। সাবেক কোচ জেমি সিডন্সকে দেখতাম অনুশীলনে পেসারদের দিয়ে ১৮ গজ দূর থেকে বোলিং করাতেন, গ্রানাইট ব্যবহার করতেন। এখন আর সে রকম চেষ্টা দেখি না।’ টেস্টের ব্যাটিংয়ের জন্য আলাদা কোচেরও প্রয়োজন মনে করেন বিসিবির সাবেক এই পরিচালক।
সমস্যা সমাধানে বিসিবির চোখে পড়ার মতো কোনো উদ্যোগ নেই
গাজী আশরাফের আরেকটি পরামর্শ, অন্য দেশের সঙ্গে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দল বিনিময় চুক্তি করা, ‘আমরা ভারত বা ক্রিকেটে উন্নত কোনো দেশের দলকে আমাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলাতে পারি, বিনিময়ে আমাদের একটা দল তাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলবে। আমরা আমাদের খেলোয়াড়দের বিদেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলানোরও চেষ্টা করতে পারি, তাহলে তারা সেই দেশের কন্ডিশনে অভ্যস্ত হবে।’ বাংলাদেশের ক্রিকেটে এগুলো নতুন কোনো কথা নয় অবশ্য। সমস্যা হলো, এ দেশের ক্রিকেটের কর্তাব্যক্তিরা রংচঙে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এতটাই মজে আছেন যে সেই রং ধরে রাখতে ফ্যাকাশে ঘরোয়া ক্রিকেটটাকে উন্নয়নের তুলিতে রাঙানোর প্রয়োজন উপলব্ধি করারও সময় পান না।