ভোলা প্রতিনিধি ॥ খেতের চারদিকে বেড়িবাঁধের মতো উঁচু মাটির ঢাল। সেই ঢালে মাচায় ঝুলে আছে তরমুজ। একটি-দুটি নয়, হাজার হাজার তরমুজ। ভোলার সদর উপজেলার চরমনষা গ্রামে সবুজবাংলা কৃষি খামারের দৃশ্য এটি। মাচায় ঝুলে থাকা তরমুজগুলো বাহারি রঙের। কোনোটির গায়ে ডোরাকাটা দাগ, কোনোটি কালচে সবুজ, আবার কোনোটি ফ্যাকাশে সবুজে। তরমুজগুলোর ভেতরের রঙেও পার্থক্য আছে। কোনোটি কাটলে ভেতরে টকটকে লাল, আবার কোনোটি পাকা মাল্টার মতো হলুদাভ কমলা।
এ খামারের পরিচালক ইয়ানুর রহমান। চলতি বছর তিনি ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছ থেকে জেলার শ্রেষ্ঠ কৃষকের পুরস্কার পেয়েছেন। একটি সংবাদ পড়েই ইয়ানুর প্রথম জানতে পারেন, ভোলায় বারোমাসি ফল তরমুজের আবাদ হয়। তাই এ বছর আশ্বিন মাসে পরীক্ষামূলকভাবে ৫০ শতাংশ জমিতে তিনি বেবি তরমুজের আবাদ করেছেন। ফলনও বেশ ভালো হয়েছে বলে জানান তিনি। ইয়ানুর রহমান বলেন, ৫০ শতাংশ জমিতে ৩ হাজার গাছে প্রায় ১২ হাজার ফল পেয়েছেন। যদিও ফল আরও বেশি হয়েছিল। তবে তিনি অনেক ফল ছেঁটে ফেলেছেন। সব মিলিয়ে তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। কমপক্ষে আড়াই লাখ টাকায় তরমুজ বিক্রি হবে বলে আশ করেন তিনি। ইয়ানুরের খামার ঘুরে দেখা যায়, বাঁধের ঢালে একটু সমান্তরাল করে লম্বা বেড তৈরি করা হয়েছে। এক লাইনে একটি বেড। বেডের ওপর এক হাত পরপর চারা লাগানো হয়েছে। বেডের সামনে খেতের দিকে মাচা দেওয়া হয়েছে। সেই মাচায় ঝুলে আছে ছোট-বড় কয়েক শ তরমুজ। এখানে মোট ছয় জাতের তরমুজের বীজ লাগানো হয়েছে বলে জানান ইয়ানুর।
ইয়ানুরের খেতের দেখভাল করেন মোসলেহউদ্দিন। কথোপকথনের ফাঁকে আপ্যায়নের জন্য তিনি খেত থেকে ছিঁড়ে কয়েকটি তরমুজ কাটলেন। যদিও তরমুজগুলো এখনো ভালো করে পাকেনি। তারপরও তরমুজগুলোর ভেতর হলুদাভ ও লাল রং ধারণ করেছে। খেতেও বেশ রসাল ও মিষ্টি। কচি অবস্থায় এসব তরমুজ তরকারি হিসেবে ভাজি বা রান্না করে খাওয়া যায়। অসময়ে খেতের মাচায় তরমুজ ঝুলতে দেখে চরমনষার কৃষকেরা অবাক হয়ে গেছেন। তাই প্রতিদিনই চরমনষা ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের চাষিরা ইয়ানুরের তরমুজের খেত দেখতে আসেন। ফলন আর লাভের কথা শুনে তাঁরাও বেবি তরমুজ চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
ভোলার বাজারে অসময়ে প্রথম যখন বেবি তরমুজ ওঠে, তখন ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। তবে এখন দাম কমে ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরবরাহ খুব বেশি থাকে না বলে এসব তরমুজ বাজারে আনলে নিমেষেই বিক্রি হয়ে যায়। ভোলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষিবিদ ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও গ্রামীণ জনোন্নয়ন সংস্থার (জিজেইউএস) কৃষি ইউনিটের সহযোগিতায় ভোলায় বছর চারেক আগে প্রথমবারের মতো বেবি তরমুজের আবাদ শুরু হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ভোলায় এখন বাণিজ্যিকভাবে অনেকেই বেবি তরমুজের আবাদ শুরু করেছেন।
জিজেইউএসের কৃষি ইউনিটের উপপরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, ১ বিঘা বা ৩৩ শতাংশ জমিতে বারোমাসি তরমুজের আবাদ করতে সর্বোচ্চ ৪৫-৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। ১ বিঘা জমিতে ১ হাজার ২০০টি পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়। ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যে প্রতি বিঘা জমিতে সর্বনিম্ন ২ হাজার ৪০০ ফল উৎপাদন করা সম্ভব, যা ওজন করলে দাঁড়ায় ৫ থেকে সাড়ে ৫ মেট্রিক টন। অর্থাৎ সর্বনিম্ন ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও দুই থেকে আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর বলেন, বারোমাসি বেবি তরমুজ কৃষি খাতে এক অনন্য সংযোজন। আগে এ জাতের তরমুজ বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। তবে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলে এ তরমুজ এখন দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। কম জমিতে এ ফল আবাদ করে অল্প সময়ে ফলন পাওয়া যায় বলে কৃষকদের কাছে এটি দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। ভোলা সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, জলাবদ্ধতা নেই, পানি জমে না এমন উঁচু জমিতে বারোমাসি বেবি তরমুজের আবাদে সফলতা আসবে। ‘সুইট ব্ল্যাক’ বা কালো জাত, নতুন ‘গোল্ডেন ক্রাউন’ বা হলুদ জাতসহ কয়েকটি বারোমাসি বেবি তরমুজের জাত ভোলার কৃষকদের মধ্যে আশার সঞ্চার করছে।