শরীফ খান ॥ সুপারিবাগানটার ভেতর একটি গোলাকার ডোবা। ঝোপঝাড় ও লতাপাতার অবাধ বিস্তার ওই ডোবাকে ঘিরে। ডোবাটার তলায় এখন একটুখানি পানি। ওইটুকু পানির ওপর ঝরা পাতার বিছানা পাতা। এখন সকাল। শিশিরভেজা ওই বিছানা শুকায়নি তবু। ওই বিছানার ওপর একটি রংচঙে পাখি খাবার খুঁজছে। ছোট লেজের পুচ্ছটা মাঝে মাঝে দোলাচ্ছে, ফোলাচ্ছে শরীরের পালক ও খাবার পেলেই পাখা দুখানা মেলে আনন্দ প্রকাশ করছে। ধীরে–সুস্থে ওটা খুব মনোযোগসহকারে একটি একটি করে ঝরা পাতা ওলটাচ্ছে, পোকা ও লার্ভা পেলে খাচ্ছে, কোনো উড়ন্ত পোকা পালাতে চাইলে দুই পাখার বাতাস ঢেলে ওটাকে স্থির করে দিচ্ছে।
হাটবার আজ। সুপারি পাড়তে ‘গাছারু’ ছেলেটি এল। ডোবা থেকে অল্প দূরের একটি গাছে উঠল সে দড়ির ‘ফাঁদি’ পায়ে, পাকা সুপারির কাছি টেনে ছিঁড়ে সে ফেলল তলায়, একটি শটি ঝোপের মাথায় সশব্দে পড়তেই ভয় পেল ডোবার পাখিটি, ছিটকে উঠেই ওটা সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে উড়ে পালানোর সময় বাগান থেকে বেরিয়েই আটকে গেল জালে। ‘শাকসবজি’ খেতের চারপাশ ও ওপরটা জুড়ে মশারির মতো টানানো ওই জাল। জালে পড়েই ছটফটানি, মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা, গাছরু ছেলেটি তা দেখল, সুড়ুৎ করে সুপারিগাছ বেয়ে নেমে ছুটে গিয়ে ধরে ফেলল সুন্দর পাখিটিকে। ঘটনাটি ঘটে গেল ৩০ নভেম্বর, স্থান বাগেরহাট সদর উপজেলার একটি গ্রামের।
আমার এক কলেজবন্ধু ভিডিও কল দিলেন আমাকে। ঢাকায় বসে দেখলাম পাখিটিকে, আহারে শান্তি! ডিজিটাল যুগে ভিডিও কলে ঢাকায় বসে সরাসরি দেখছি পাখিটিকে। সুপারিবাগানটার মালিক তিনিই। মাঝেমধ্যেই দেখেন পাখিটিকে। চেনেনও। পাখি আছে এক জোড়া। জালে আটকা পড়া পাখিটির নাম রঙিলা দোয়েল। বাগেরহাট-ফকিরহাটে এটি প্রতিবছরই দেখা যায়। ‘আঁশালো বাদামি দামা’ নামে এটি বেশি পরিচিত। শীতের পরিযায়ী মাটিচর এই নিরীহ-সুন্দর পাখিরা কম সংখ্যায় আসে আমাদের দেশে। ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলসহ শহরতলিতে গেল ৪৭ বছরে পাখিটিকে আমি ১৯ বার দেখেছি।
গড়ন-ধরনে আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েল বা কমলাদোয়েল আকৃতির পাখিটি সত্যিই রঙিন-সুন্দর। একনজরে মাথার তালুসহ ঘাড়-পিঠ ও লেজের উপরিভাগ চকচকে জলপাই-সোনালি রঙের। সাদাটে গলা-বুক-পেট ও লেজের তলাসহ মাথা-পিঠজোড়া যেন নিপুণ শিল্পীর অনুপম শিল্পকর্মে সজ্জিত। ছোট মাছের ছোট ছোট আঁশের মতো নকশাদার ঘন-বাদামি রঙের টাইলস যেন সেট করা। চোখ অনেকটাই ডাগর ডাগর, যে চোখে সব সময় একটা ভয় ভয় ভাব ফুটে থাকে। ঝরা পাতা, কাদামাটিসহ ঘাসের রঙের সঙ্গে ক্যামোফ্লেজ হয়ে থাকে। কানপট্টি কালো। কালচে ঠোঁট, কমলা পা। উড়লে দুই পাখার এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত জোড়া জলপাই-সোনালি রেখাটা নজরে পড়ে। খাদ্যতালিকায় আছে নানা রকম পোকামাকড় ও মাটিতে ঝরে পড়া কিছু ছোট ছোট ফল। ছোট তেলাপোকা-টিকটিকি-গিরগিটির বাচ্চা-ব্যাঙের ছানা ও ব্যাঙাচি-কেঁচো-ঘুগরা পোকা ইত্যাদি। ক্বচিৎ ছোট খেজুরগাছের নলিতে বসে রস পান করে। মূল চারণক্ষেত্র গ্রামীণ বন, ঝোপঝাড়ের তলা, আখখেত, কলাবাগান, পানের বরজ, ধানখেত, কুটোর পালার তলা ও আশপাশটা। কচুরিপানার জমাট ভাসমান প্ল্যাটফর্মেও চরে। রাত কাটায় গাছের সরু ডাল বা বাঁশের কঞ্চিতে বসে। শরীরের পালক ফুলিয়ে পটকা মাছ বা টেনিস বলের মতো হয়ে যায়, ঘাড় পেছন দিকে ঘুরিয়ে পিঠে ঠোঁট গুঁজে ঘুমায়।
রঙিলা দোয়েলের ইংরেজি নাম স্ক্যালি থ্রাশ। বৈজ্ঞানিক নাম তড়ড়ঃযবৎধ ফধঁসধ. দৈর্ঘ্য ২৬ সেন্টিমিটার।