বিশ্বজিৎ পাল বাবু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ॥ ৩০ পারার পবিত্র কোরআন শরীফ। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে মাত্র দুই ইঞ্চির কম! স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ের রেডিও সেট। ১৮৮০ সালের ধাতব মুদ্রা। এমনই সব গুরুত্বপূর্ণ ও বিচিত্র সংগ্রহ দেখা যাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরে। গত ১৩ জানুয়ারি উদ্বোধন করা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরের। মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও নানা সাংস্কৃতিক নিদর্শন দিয়ে সাজানো হয়েছে এই জাদুঘর। আপাতত প্রদর্শিত আইটেমের সংখ্যা ১১১। ১০০ থেকে ৩০০ বছরের পুরনো এগুলো। তবে এখানে রক্ষিত একটি জীবাশ্ম লাখো বছর আগের বলে দাবি করা হচ্ছে।
জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা জেলা উদীচীর সভাপতি জহিরুল ইসলাম স্বপন জানান, বছর দুয়েক আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি জাদুঘর করার পরিকল্পনা শুরু হয়। এগিয়ে আসেন সদ্যোনিয়োগ পেয়ে আসা জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান। তিনি স্থানীয় কয়েকজনকে দায়িত্ব দেন মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উপকরণ সংগ্রহ করার জন্য। জায়গার দায়িত্ব নেন তিনি নিজেই। দক্ষিণ মৌড়াইল এলাকায় সাবেক এসি ল্যান্ড অফিস মেরামত করে সেখানে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
জাদুঘরের প্রথম সংগ্রহ মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের একটি ম্যাপ। আখাউড়া উপজেলার তন্তর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল হক বীরপ্রতীকের কাছ থেকে পাওয়া যায় ওই ম্যাপ। এর পর থেকে একে একে সংগ্রহে জমা হয় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার রেডিও, গ্রামোফোন রেকর্ড, ডাক বিভাগের পুরনো খাম, পুরনো মুদ্রা, টাইপরাইটার, বিভিন্ন লোকজ জিনিস। এ ছাড়া জাতীয় ও জেলা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, স্থান ও স্থাপনার ছবি রয়েছে জাদুঘরে। জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকেই স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসে। মাঠ পর্যায়ে কাজের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ইতিহাস, ঐতিহ্যের জিনিস যার বাড়িতে আছে সেখানেই ছুটে যেতে থাকেন।
ক্ষুদ্রাকার কোরআনটি ইতালিপ্রবাসী বন্ধু মাহমুদুর রহমানের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুস্তক বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি মো. মমিনুল হক বাবু। বছর পাঁচেক আগে পাওয়া এ উপহার তিনি তুলে দিয়েছেন জাদুঘরে। স্থানীয় জমিদার পরিবারের সন্তান সরোজিনী রায়ের নামে এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি বিদ্যালয়। শিক্ষায়তনটিকে ১৯৩৭ সালে শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে দুটি পেয়ালা পাঠিয়েছিলেন তিনি। কালক্রমে ওই বিদ্যালয়ের নাম হয়েছে মডেল গার্লস স্কুল। এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পারভীন আক্তারের কাছ থেকে সংগ্রহ করে পেয়ালা দুটি জাদুঘরে এনে রাখেন জহিরুল ইসলাম স্বপন। হালদারপাড়ার পাপড়ি পালের বাড়ি থেকে এসেছে পুরনো মুদ্রা ও ডাকটিকিট। পাইকপাড়ার অধ্যাপক হরলাল রায়ের বাড়ি থেকে পাওয়া গেছে টাইপরাইটার। স্টেশন রোডের ইসমাইল মিয়া দিয়েছেন ১৯৫৪ সালের একটি রেডিও, যেটিতে লেখা আছে পূর্ব পাকিস্তান সরকার। নবীন পালের বাড়ি থেকে এসেছে ১৫০ বছরের পুরনো পিতলের হুক্কা। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে রেখে দেওয়া প্রাথমিক চিকিৎসা ও গুলির বাক্সও জাদুঘরে রাখা হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয় পুরাতন জেলা রোডে সরিয়ে নেওয়ার পর থেকে ভবনটি কার্যত পরিত্যক্ত ছিল। সেখানেই জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেয় জেলা প্রশাসন। বিভাগীয় কমিশনারের টিআর কর্মসূচি ও জেলা প্রশাসকের বিশেষ বরাদ্দসহ বিভিন্ন মাধ্যমে জাদুঘর নির্মাণের অর্থ জোগাড় করা হয়। এটি প্রতিষ্ঠায় প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। জাদুঘরে প্রদর্শিত দ্রব্যগুলো সংগ্রহে কাজ করা জেলা উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি জহিরুল হক স্বপন কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রায় দুই বছর যাবৎ তাঁরা কয়েকজন এ নিয়ে কাজ করেছেন। মাঠে থেকে তিনি ছাড়াও কাজ করেছেন ফারুক আহমেদ ও ফেরদৌস রহমান। কবি জয়দুল হোসেন, লেখক রেজাউল করিম, এস আর এম ওসমান গণি সজিব, মমিনুল হক বাবু নানাভাবে পরামর্শ দিয়েছেন। তৎকালীন জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খানের পাশাপাশি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. রুহুল আমীন নিয়মিত তদারক করেছেন।
‘ধীরে ধীরে একে আমরা একটি সমৃদ্ধ জাদুঘর হিসেবে গড়ে তুলতে পারব বলে আশা করি’, বললেন স্বপন। জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক আবদুন নূর বলেন, ‘এই জাদুঘরের কারণে পরবর্তী প্রজন্ম জেলার মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবে। তবে জাদুঘরটিকে আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। এ জন্য সবার সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন। ’ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে জেলায় একটি জাদুঘর নির্মাণের জন্য দাবি ছিল। কিন্তু এত দিন কেউই উদ্যোগটি গ্রহণ করেননি। জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করায় বিদায়ি জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ। এর মাধ্যমে স্থানীয় মানুষ জেলা তথা দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে জানতে পারবে। ’