শফিকুল ইসলাম ॥ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে অনেক। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে বাড়েনি আয়। ফলে টিসিবির লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। টিসিবি’র ট্রাক থেকে কেউ যদি দুই কেজি করে তেল, দুই কেজি ডাল, দুই কেজি চিনি এবং তিন কেজি পেঁয়াজ কেনেন, তাতে খরচ হচ্ছে ৫৫০ টাকা। খুচরা বাজার থেকে একই পরিমাণ পণ্য কিনতে লাগছে ৮৪০ টাকা। ফলে একজন ক্রেতার সাশ্রয় হচ্ছে ২৯০ টাকা। তবে এই ২৯০ টাকা বাঁচাতে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লাগছে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা।
টিসিবির ট্রাক থেকে একজন ক্রেতা প্রতিকেজি চিনি ৫৫ টাকায়, মসুর ডাল ৬৫ টাকায়, সয়াবিন তেল প্রতিলিটার ১১০ টাকায় এবং পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৩০ টাকায় কিনতে পারছেন। একজন ক্রেতা সর্বনিম্ন দুই থকে সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি পেঁয়াজ, দুই কেজি মসুর ডাল, দুই কেজি চিনি ও দুই লিটার সয়াবিন তেল কিনতে পারছেন। ক্রেতারা জানিয়েছেন, তারা মূলত সয়াবিন তেল, মুসুর ডাল ও চিনি কেনার জন্যই টিসিবির লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। কিন্তু টিসিবি কর্তৃপক্ষ এক প্যাকেজের আওতায় ডাল, চিনি ও পেঁয়াজ কিনতে বাধ্য করছে।
রাজধানীর ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে অবস্থিত মাতুয়াইলের মা ও শিশু হাসপাতালের সামনে শত শত মানুষের লাইন দেখা যায় সকাল ৯টার পর থেকেই। ওভার ব্রিজ ঘেঁষে এই লাইন ক্রমশ রায়ের বাগের দিকে বাড়তে থাকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। একই চিত্র শনির আখড়া বাসস্ট্যান্ডের সামনেও। দনিয়া কলেজের গেট ধরে লাইনে দাঁড়ানো শত শত নারী পুরুষ টিসিবির পণ্য কেনার অপেক্ষায়। টিসিবির গাড়ি আসতে আসতে কখনও সাড়ে ১১টাও ছাড়িয়ে যায়। এক প্যাকেজ (দুই লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি মুসুর ডাল, দুই কেজি চিনি এবং পাঁচ কেজি পেঁয়াজ) পণ্য কেনার জন্য এসব মানুষ রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে দুই থেকে তিন ঘণ্টা।
জানতে চাইলে প্রেসক্লাবের সামনে টিসিবির ট্রাকের সামনে দাঁড়ানো সচিবালয়ের কর্মচারী মকবুল হোসেন জানিয়েছেন, বাজারে এক লিটার সয়াবিন তেল কিনতে লাগে ১৬৮ থেকে ১৭০ টাকা। এখানে পাওয়া যায় ১১০ টাকায়। দুই লিটারের এক বোতল সয়াবিনে ১২০ টাকা সাশ্রয় হয়। একইভাবে বাজারে এক কেজি মুসুর ডালের দাম ১০০ টাকা। এখানে ৬৫ টাকা। দুই কেজি ডালে সাশ্রয় ৭০ টাকা। বাজারে এক কেজি চিনির দাম ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। এখানে ৫৫ টাকা। ২ কেজি চিনিতে সাশ্রয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা। তাই একটি প্যাকেজে তিনটি পণ্য কিনলে মোট ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা সাশ্রয় হয়। এ কারণেই লাইনে দাঁড়িয়েছি।
খুচরা বাজারে প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৫০ টাকা। টিসিবির ট্রাকে তা ৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। টিসিবির বেশিরভাগ ট্রাকে তিন কেজি করে পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে ক্রেতাদের। তাতে একজন গ্রাহকের সাশ্রয় হচ্ছে ৬০ টাকা। মোট ২৯০ টাকা সাশ্রয় করতে একজন ক্রেতা দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় পার করছে ঠায় রোদে দাঁড়িয়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নতুন বছর ২০২২ শুরু থেকেই নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন। এতে অব্যাহতভাবে বাড়ছে মূল্যস্ফীতির হার। বিশেষ করে সয়াবিন তেল, ডাল, চিনির দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। ফলে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ, যা গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় বেশি। গত ডিসেম্বরে ছিল ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ক্যাব’র সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির বলেন, আগে টিসিবির লাইনে নিম্মআয়ের মানুষেরাই দাঁড়াতেন। এখন মধ্যবিত্তরাও দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে বাড়ছে না আয়। ফলে টিসিবির লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। টিসিবির লাইনে দাঁড়ানো ছাড়া তাদের উপায় নেই।
এ বিষয়ে টিসিবির মুখপাত্র হমায়ুন কবির জানিয়েছেন, বাজারের তুলনায় টিসিবির পণ্যের মান ভালো এবং দাম অনেক কম হওয়ায় সাধারণ মানুষের লাইন বড় হচ্ছে। এই সুযোগে একটি চক্র একাধিকবার লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য নিয়ে যাচ্ছে। লাভের জন্য সেসব পণ্যগুলো খোলা বাজারে বিক্রি করছে বলেও অভিযোগ শুনছি। এসব প্রতারকদের ঠেকানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে প্রয়োজনীয় বাড়তি জনবল টিসিবির নেই বলেও জানান তিনি।
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সারাদেশে ৪৫০টি পয়েন্টে এখন ট্রাকে করে টিসিবির পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরসহ ঢাকা বিভাগে ১০১টি পয়েন্টে পণ্য বিক্রি হয় । গত শুক্রবার বাদে সপ্তাহে প্রতিদিন প্রতিটি ট্রাকে দিনে ৬০০ লিটার সয়াবিন তেল, ৪০০ কেজি ডাল, ৫০০ কেজি চিনি এবং ৫০০ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। এবারের কার্যক্রম চলবে আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, সাধারণ আয়ের মানুষদের জীবনে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য দিতেই সরকার ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির মাধ্যমে তেল, চিনি, মসুর ডাল ও পেঁয়াজ বিক্রি করছে। পক্ষান্তরে খাদ্য অধিদফতরের মাধ্যমে একইভাবে ভর্তুকি মূল্যে আটা ও চাল বিক্রি করছে। এতে সাধারণ আয়ের মানুষরা সুবিধা পাচ্ছেন।