বিশ্বজিৎ পাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ॥ পাঠ্যসূচিতে বাক্য ও শব্দ গঠন করার মতো আরো অনেক পড়া। তবে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দেওয়া হলো স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ লিখতে। সবাই কোনো রকমে স্বরবর্ণ লিখলেও ব্যঞ্জনবর্ণগুলো পারল না বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার আতুকুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘটনা এটি।
শিক্ষক মো. নাজমুল হোসেন জানান, টানা দুই বছর পড়াশোনার সঙ্গে নেই শিক্ষার্থীরা। নির্দেশনা মোতাবেক নানাভাবে চেষ্টা করেও তাদের যুক্ত করা যায়নি। যেসব শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা সচেতন তারাই কেবল বাড়িতে পড়িয়ে ধারাবাহিকতা রেখেছেন। অন্যদের বেলায় সেটা হয়নি বলে পিছিয়ে পড়েছে। শ্রেণি শিক্ষক মুক্তা চৌধুরীও শিক্ষার্থীদের এমন সমস্যার কথা স্বীকার করেন।
ব্ল্যাকবোর্ডে আলাদা করে ‘আমাদের’ লিখে শিক্ষার্থীদের পড়তে বললেন শিক্ষক। সবাই সমস্বরে উত্তর দিল, ‘আমাদের দেশ’। লজ্জিত হাসিমুখ নিয়ে এই প্রতিবেদকের দিকে তাকালেন শিক্ষক। বললেন, ‘মুখস্থ করার প্রভাব। বাড়িতে সম্ভবত আমাদের দেশ নামে কবিতা মুখস্থ করেছে। ’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার নয়াদিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির কক্ষে গত ৫ মার্চ সকালে গেলে এমন পরিস্থিতি দেখা যায়। পড়াতে থাকা শিক্ষক মো. হাছিব আলী রাশেদ বলেন, ‘দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার জের পড়েছে প্রতিটি ক্লাসে। ’ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে করোনায় বন্ধ থাকার প্রভাব শিক্ষার্থীদের মাঝে পরিলক্ষিত হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে বোঝা যায়, দুর্বল ভিতের ওপর গড়ে উঠছে শিক্ষার্থীরা। এতে নড়বড়ে তাদের শিক্ষা জীবন।
বিশেষ করে ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতির শুরুতে যেসব শিক্ষার্থী প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে তাদের অবস্থা বেহাল। বর্ণ শিখতে আসা শিক্ষার্থীদের এখন বাক্য ও শব্দ গঠন করতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। এর মধ্যে গত দুই বছর তারা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা না করেই প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠেছে। একইভাবে অন্যান্য ক্লাসের শিক্ষার্থীরাও বিদ্যালয়ে না পড়েই দুই ক্লাস ওপরে পড়াশোনা করছে। কিন্তু পাঠ্যসূচি একই রয়েছে।
আখাউড়ার রাধানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। যে কারণে আমাদের পেছনের পড়া পড়ানোর একটা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ’ কথা হলে নবীনগর উপজেলা মাঝিকাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবেরা বেগম বলেন, ‘স্বাভাবিক কারণেই শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়েছে। ’ আখাউড়ার নয়াদিল গ্রামের বাসিন্দা মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘দুটি ক্লাস না পড়ে পরবর্তী ক্লাসে তুলে দেওয়ায় সমস্যা হওয়াটা স্বাভাবিক। ’ নয়াদিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হালিমা আক্তার বলেন, ‘বন্ধের সময় আমাদের অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নানা কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। ’ ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহমুদা আক্তার বলেন, ‘যারা এখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে তারা তো ভালো করে অক্ষরই চেনে না। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। ’
আখাউড়ার জাঙাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক ফৌজিয়া আক্তার বলেন, ‘পাঠ্যসূচি অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের পড়াতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। ’ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মনির হোসেন বলেন, ‘অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী পাঠ পরিকল্পনার বাইরে যেন সময় দেওয়া হয়, সেটা করা হচ্ছে। ’ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর যখন প্রথমবার স্কুল খুলল, তখনই পূর্ববর্তী পাঠ্যসূচি সংযুক্ত করে পাঠদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেভাবে পাঠদান করা হচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করা হচ্ছে। ’