বিশ্বজিৎ পাল বাবু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ॥ মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে। স্বামী প্রতিবন্ধী; চোখে দেখেন কম, পায়ে সমস্যা বিধায় চলতেও বিপত্তি। বিয়ের ১৫ দিন পর বাবার বাড়ি ফিরে যান রিমা। গরিব মানুষ, অন্যত্র বিয়ে দিতে আবার কোথায় টাকা পাবে পরিবার- ইত্যাদি সব বুঝিয়ে রিমাকে স্বামীর বাড়ি পাঠানো হয়। বিয়ের বছর খানেকের মাথায় পুত্র সন্তানের জন্ম দেন রিমা। দুদিন পর মারা যায় সেই সন্তান। এই কষ্টের পাশাপাশি স্বামীর সেবা যতেœও রিমা কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। স্বামীর আর্থিক দুরাবস্থাও তাকে ভাবাচ্ছিলো। সংসার জীবনটা বিষিয়ে উঠার কথা আবারো জানায় বাবার বাড়ির লোকজনকে। সবাই আবারো তাকে বুঝিয়ে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের দিকে ঝোঁক বাড়ে রিমার। ইয়াছিন ও মোরসালিন নামে দুই সন্তান তাদের সংসারে। তবে শারিরিক জটিলতায় আর সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই রিমার। স্বামীর পাশাপাশি নিজেও কাজে যোগ দেন।
সেই রিমা এখন ‘খুনি’। তাও নিজের দুই সন্তানকে খুন করেছেন। আদালত ও পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে রিমা হত্যাকান্ডে বর্ণনা দিয়েছেন। জানিয়েছেন, পরকীয়া প্রেমিকের পাঠানো বিষ মেশানো মিষ্টি খাইয়ে দুই সন্তানকে খুন করেন। ২৫ বছর বয়সি রিমা জানান, শারিরিকভাবে অক্ষম স্বামীর প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণে পরকীয়ায় আসক্তি। প্রেমিকের শর্ত- একান্তই তাকে পেতে চায়। সন্তানদেরকে সঙ্গে নিয়ে সে এ সম্পর্ক মেনে নিবে না। এ অবস্থায় প্রেমিকের সঙ্গে পরিকল্পনা করেই দুই সন্তানকে নিজ হাতে বিষ খাইয়ে হত্যা করেন। পরে নাপা সিরাপ খেয়ে শিশুদের মৃত্যু হয়েছে বলে অপপ্রচার চালানো হয়।
গত ১০ মার্চ ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে মারা যায় মো. ইয়াছিন খান (৭) ও মো. মোরসালিন খান (৫)। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের মো. ইসমাইল হোসেন সুজনের দুই সন্তান তারা। ১২-১৩ বছর আগে ইসমাইলের সঙ্গে বিয়ে হয় রিমার। পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে যে, প্রেমিকের দেওয়া শর্ত মানতে তার পাঠানো মিষ্টি খাইয়ে দুই শিশুকে হত্যা করেছে তাদের মা রিমা। হত্যাকান্ডের পর থেকেই পুলিশ ওই নারীকে নজরদারিতে রাখেন। মোবাইল ফোনের কথার সূত্র ধরে ওই নারীকে সন্দেহ করতে থাকে পুলিশ। শেষ পর্যন্ত ওই সূত্র ধরেই পুলিশ হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়।
ঘাতক মা রিমা আক্তারকে আসামি করে গত বৃহস্পতিবার সকালে আশুগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করে শিশুদের বাবা উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা ও ইটভাটার শ্রমিক মো. ইসমাইল হোসেন খান সুজন। এর পরই পুলিশ ওই নারীকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতে পাঠায়।
এ বিষয়ে দুপুরে হওয়া সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান জানান, রিমা বেগম একটি চাল কলে কাজ করেন। সেখানকার শ্রমিক সর্দার শফিউল্লাহর সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শফিউল্লাহ ওই নারীকে আর্থিকভাবেও সাহায্য করতেন। এরপর তাদের মধ্যে শারিরিক সম্পর্ক হয়। স্বামী সুজন চোখে কম দেখেন ও হাঁটচলাতেও সমস্যা বিধায় রিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন শফিউল্লাহ। তবে শর্ত দেন যে দুই সন্তানকে ছেড়ে আসতে হবে। এরপরই থেকে দু’জন মিলে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ি ১০ মার্চ বিকেলে বিষ মিশিয়ে মোট পাঁচটি মিষ্টি পাঠায় শফিউল্লাহ। এর মধ্যে ইয়াছিন তিনটি ও মোরসালিন দু’টি মিষ্টি খায়। এরই মধ্যে তাদের দাদিকে দিয়ে নাপা সিরাপ আনানো হয়। মিষ্টি খাওয়ার পর দু’জন অস্বস্থিবোধ করলে ঘটনা ধামাচাপা দিতে নাপা সিরাপের কথা বলা হয়।
পুলিশ সুপার জানান, ঘটনার দিন ১৫ বার শফিউল্লাহ ও রিমার মধ্যে কথা হয়। সেই ফোন কলের সূত্র ধরেই তদন্ত করে পুলিশ। এরই মধ্যে শফিউল্লাহ কৌশলে রিমার কাছ থেকে মোবাইল ফোনটি নিয়ে যায়। কেননা, যে সিম ব্যবহার করে রিমা কথা বলতেন সেটি ছিলো শফিউল্লাহর। মোবাইল ফোনটি কোথাও?- বুধবার রাতে রিমার কাছে জানতে চায় শফিউল্লাহ। তখন রিমা অসংলগ্ন কথা বলতে থাকে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। নানা তথ্য উপাত্ত হাতে পেয়ে রাতেই পুলিশ রিমাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ধীরে ধীরে রিমা হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করেন।
পুলিশ সুপার জানায়, ওই নারীর প্রতি পুলিশের কঠোর নজরদারি ছিলো। লোকজন গেলেই সে ছেলেদের জন্য কান্নাকাটি করতো। কিন্তু এমনিতে বাড়িতে খুব স্বাভাবিক থাকতো। তার খাওয়া-দাওয়া ছিলো খুবই স্বাভাবিক। এর পাশাপাশি তার মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে পুলিশ তদন্ত কাজ এগোয়। ঘটনার পর পুলিশ যদি ফোন নিয়ে সব জেনে যায়- সে ভয় থেকে শফিউল্লাহ ফোনটি রিমার কাছ থেকে নিয়ে যান। এদিকে শিশুদের জন্য যে ফার্মেসি থেকে নাপা সিরাপ আনা হয় সেখান থেকে আটটি নিয়ে পরীক্ষা করে ওষুধ প্রশাসন। তবে পরীক্ষায় কোনোটাতেই ক্ষতিকারক কিছু যাওয়া যায়নি বলে ওষুধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়। যে সিরাপ খেয়ে মৃত্যু হয়েছে সেটিও ওষুধ প্রসাশন পরীক্ষা করে দেখছে। পুলিশ বলছে, ওই দুই শিশুর ভিসেরা রিপোর্টের পাশাপাশি নাপা সিরাপের পরীক্ষার রিপোর্টের জন্য তারা অপেক্ষা করছেন। জবানবন্দি দেওয়া মায়ের কথার সঙ্গে ওই রিপোর্টের মিল থাকে না কি-না সেটিও যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে।