উদিসা ইসলাম ॥ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ওই সেনা অভিযানের সাংকেতিক নাম বা কোড নেম দিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। এক রাতে এই হামলায় অর্ধ লাখ মানুষের প্রাণহানী হয়েছিল। সেই রাতটিকে স্বাধীন বাংলাদেশে বর্ণনা করা হয় ‘কালরাত’ হিসেবে। বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, অভিযানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হিসেবে দুটি বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছিল— ‘শেখ মুজিবের ডিফ্যাক্টো শাসনকে উৎখাত করা এবং সরকারের (পাকিস্তানের) কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।’
গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় ঢাকা তখন বিক্ষোভের শহর। ঢাকায় ইতোমধ্যে ওড়ানো হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এরই মধ্যে ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিয়েছেন। ডামি রাইফেল নিয়ে ঢাকার রাস্তায় মার্চ করছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। ঢাকায় তখন চলছে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক। এরকম প্রেক্ষাপটে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে বাংলার মানুষের আত্মবিশ্বাস ভেঙে ফেলার ষড়যন্ত্র হয়। এই অভিযানটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল তারও এক সপ্তাহ আগে, ১৮ই মার্চ।
‘কালরাতের’ সেই ভয়াবহ সেনা অভিযানের পরিকল্পনা কীভাবে হয়, আর কী ছিল উদ্দেশ্য— তার ধারণা পাওয়া যায় সেসময় ঢাকায় দায়িত্বরত পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের স্মৃতিকথা থেকে, আর সেদিনের স্মৃতি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বয়ানে। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আলোচনায় ‘প্রত্যাশিত অগ্রগতি’ হচ্ছিল না। মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা তখন পূর্ব পাকিস্তানের ১৪তম ডিভিশনের জিওসি ছিলেন। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সামরিক অভিযানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী তিনি। ‘আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি ইস্ট পাকিস্তান, ১৯৬৯-১৯৭১’ শিরোনামের স্মৃতিচারণমূলক একটি গ্রন্থ লিখেছেন তিনি। এই গ্রন্থের তথ্যমতে, ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান টেলিফোনে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজাকে কমান্ড হাউজে ডেকে পাঠান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘মিলিটারি অ্যাকশনের’ জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন বলে তাদের জানানো হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ মার্চ সকাল থেকে ক্যান্টনমেন্টে খাদিম হুসাইন রাজার বাসায় বসে রাও ফরমান আলী এবং তিনি মিলে অপারেশন সার্চলাইটের খসড়া তৈরি করেন।
পরিকল্পনা ছিল, দিন নির্ধারিত ছিল না
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সিদ্দিক সালিক। ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ শিরোনামের একটি বইয়ে তিনি ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নিয়ে লিখেছেন— ‘জেনারেল রাও ফরমান আলী হালকা নীল কাগজের অফিসিয়াল প্যাডের ওপর একটি সাধারণ কাঠ পেন্সিল দিয়ে ওই পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন।’ সিদ্দিক সালিক আরও জানান, ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিকল্পনা ছিল ১৬টি প্যারা সংবলিত এবং পাঁচ পৃষ্ঠা দীর্ঘ। পরিকল্পনা অনুমোদিত হলেও কবে সামরিক অপারেশন চালানো হবে সেই দিনক্ষণ নির্ধারিত ছিল না।
সময় জানিয়ে মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইনের কাছে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের কাছ থেকে ফোনটি এসেছিল ২৫ মার্চ সকাল ১১টায়। সংক্ষেপে বলা হয়েছিল, ‘খাদিম, আজ রাতেই’। সময় নির্দিষ্ট হয়েছিল রাত একটা। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেবে অবশ্য তখন ২৬ মার্চ। হিসাব করা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ততক্ষণে নিরাপদে করাচি পৌঁছে যাবেন। মুক্তিযোদ্ধা রাইসুল ইসলাম আসাদ ২৫ মার্চের ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, ‘সেদিন আমরা ঢাকাতেই ছিলাম। রাতে হঠাৎ যে হামলা শুরু হলো, তা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। ২৫ তারিখ রাতের ঘটনার পরে ২৬ তারিখ কেউ পথে বের হতে পারিনি। ২৭ তারিখ বের হয়ে যে বীভৎসতা দেখলাম, তা আসলেই কারোর কল্পনাতেও আসেনি। এত লাশ একসঙ্গে দেখে বাংলার মানুষ ভয় পেয়ে যাবে ভেবেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু তারা ভাবেনি আসলে আত্মবিশ্বাস ভাঙার ষড়যন্ত্র বুমেরাং হয়ে উঠবে। ২৫ মার্চের বীভৎসতা দেখে স্বাধীনতাকামী মানুষ আরও দ্রুত সংগঠিত হতে শুরু করে।’