প্রশান্তি ডেক্স॥ সরকার অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বৈদেশিক ঋণের ব্যবস্থাপনা করছে। এ কারণে বিদেশি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে নেই। শ্রীলঙ্কার তুলনায় বাংলাদেশের সফট লোনের (যে ঋণের সুদহার অত্যন্ত কম) পরিমাণ অনেক বেশি, আর ম্যাচিউরিটি পিরিয়ডও (ঋণের চূড়ান্ত কিস্তি পরিশোধের তারিখ) বেশি।
এছাড়াও বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এবং রপ্তানির পরিমাণ শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সমষ্টির চেয়ে বড়। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও দক্ষিণ এশিয়ার এ দুটি দেশের রিজার্ভের সমষ্টির দ্বিগুণ।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ধসে পড়ার দ্বারপ্রান্তে। আইএমএফের বেইলআউটের আওতায় রয়েছে পাকিস্তান। এই পরিস্থিতিতে বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সক্ষমতা ও টেকসইতার অবস্থা জানাতে গিয়ে এসব তথ্য দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও)।
শ্রীলঙ্কা সাময়িকভাবে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বন্ধ রাখবে বলে জানিয়েছেন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। তার এ বক্তব্যে বাংলাদেশ দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে কারেন্সি সোয়াপের আওতায় যে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছিল, তা আদায় নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশ্নের জবাবে সিনিয়র আর্থিক আমলারা গতকাল দেশের সামগ্রিক বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ আর্থিক অবস্থা সবিস্তারে উপস্থাপন করেন।
বৈদেশিক ঋণসহ দেশের অর্থনৈতিক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের এমন বিশ্লেষণ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেন দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, রাজস্ব আদায়, বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আমলারা। তারা বলেন, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের জন্য শক্তিশালী অবস্থান ছাড়াও রাজস্ব ছাড় ও আদায়ের ক্ষেত্রেও ঢাকার সঙ্গে তুলনা হয় না ঋণগ্রস্ত হয়ে দেউলিয়া হতে যাওয়া শ্রীলঙ্কার।
তিন ঘণ্টাব্যাপী এসব তথ্য বিশ্লেষণ শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস।
‘এর আগেও আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বারবার আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছি যে, বৈদেশিক ঋণ নিয়ে বাংলাদেশের সামনে দীর্ঘমেয়াদে কোনো ঝূঁকি নেই। তবু তিনি সার্বিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আশ্বস্ত হয়েছেন,’ জানান তিনি।
দক্ষিণ এশিয়ার চার বৃহৎ অর্থনীতি ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে আহমেদ কায়কাউস বলেন, গত বছর যখন মহামারির মধ্যে ভারত নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল তখন বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ শতাংশের বেশি। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী।
‘আগামী ৫-১০ বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কোনো আশঙ্কা নেই,’ উল্লেখ করে অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, গত ৮ মাসে দেশের রাজস্ব আয়ে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, বেসরকারি খাতে ক্রেডিট প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ এবং রপ্তানিতেও উচ্চ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ফলে কোনোভাবেই বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করা যায় না বলে মন্তব্য করেন অর্থ সচিব।
বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতেমা ইয়াসমিন বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের বড় অংশই বহুপাক্ষিক সংস্থা থেকে নেওয়া। এ ধরনের ঋণের সুদহার কম, গ্রেস পিরিয়ড ও ঋণ পরিশোধের মেয়াদ দীর্ঘ হয়।
অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার বেশিরভাগ ঋণ বাণিজ্যিক ও সার্বভৌম বন্ডে নেওয়া। এসব ঋণের সুদহার বেশি এবং পাঁচ বছরে সুদসহ পরিশোধ করতে হয়।
ফাতেমা ইয়াসমিন বলেন, ‘অন্যদিকে, বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধকাল ৩০ বছর। বাংলাদেশের কোনো বাণিজ্যিক ও সার্বভৌম বন্ড নেই। শ্রীলঙ্কার ঋণের সুদহার ৮ শতাংশের বেশি হলেও বাংলাদেশের নেওয়া ঋণের সুদহার ১.৪ শতাংশ।’
আগে থেকেই চাপের মধ্যে ছিল পাকিস্তানের অর্থনীতি। এর মধ্যেই দেশটিতে দেখা দিয়েছে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা, সদ্যই ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ইমরান খান। দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রীর কাঁধে এখন এমন এক টালমাটাল অর্থনীতি পরিচালনার ভার, যার ঘাটতি ঘাটতি, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে চড়চড় করে, কমে আসছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং দুর্বল হয়ে আসছে রুপি। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই শাহবাজ শরিফ বর্তমান আর্থিক চ্যালেঞ্জগুলো থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি জরুরি বৈঠক ডাকেন এবং মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক নীতির পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটি জাতীয় অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অঙ্গনও টালমাটাল হয়ে ওঠে। যার জেরে দেখা দেয় মূল্যবৃদ্ধি এবং খাদ্য, তেল ও ওষুধ সংকট। এসবের জেরে দেশটির মন্ত্রীরা রীতিমতো গণপদত্যাগ করেন। বৈদেশিক ঋণ বাড়ায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমায় শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক গতকাল বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ স্থগিত ঘোষণা করেছে।
তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল আছে। আর মুদ্রাস্ফীতির চাপ থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন পর্যন্ত কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের মতো বাহ্যিক ফ্যাক্টরগুলো ভালোভাবেই মোকাবিলা করতে পেরেছে।
এ প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের সময় দেশের আর্থিক অবস্থার খোঁজখবর নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখনও ঝুঁকিসীমার অনেক নিচে রয়েছে। উপস্থাপনাটি শুনে প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যতে ঋণের বর্তমান এই অবস্থান ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
কয়েকদিন আগেই সংসদ বক্তব্য দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, শ্রীলঙ্কার চেয়ে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে রয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও বাংলাদেশের পরিণতি শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন।
গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি শক্তিশালী স্তম্ভের চিত্র তুলে ধরে অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, গত ১৩ বছরে ধরে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে আরএমজি রপ্তানি, রেমিট্যান্স প্রবাহ ও ধান উৎপাদন বেড়েছে। সরকারের দেওয়া বিভিন্ন প্রণোদনার কারণে কোভিড-পরবর্তী সময়ে এই তিন খাতের পাশাপাশি কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
অর্থসচিব বলেন, বাংলাদেশের জিডিপির আকার শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের জিডিপির যোগফলের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণও এ দুই দেশের রপ্তানি আয়ের সমষ্টির চেয়ে বেশি। আর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার রিজার্ভের সমষ্টির দ্বিগুণ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবের তথ্যানুসারে, শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ ৩৫ বিলিয়ন ডলার এবং দেশটিকে প্রতি বছর ৭.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলার হলেও প্রতি বছর পরিশোধ করতে হয় ২.৫ বিলিয়ন ডলার।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ বেশি নমনীয় ঋণের অর্থ সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করে। আর কম নমনীয় ঋণের অর্থ ব্যয় করে লাভজনক বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে, যেখান থেকে সরকার রাজস্ব আহরণ করে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, বাংলাদেশ কখনও চীনা ঋণের ফাঁদে পড়বে না।
‘বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের মাত্র ৭.৮ শতাংশ চীন থেকে নেওয়া। ভূরাজনৈতিক কারণেই এ ইস্যুটি বিভিন্ন সময় সামনে আনা হয়,’ বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী মুখ্য সচিব আরও বলেন, ‘আমরা কখনও চীনের উপর নির্ভরশীল ছিলাম না, এখনও নেই। আমরা বেছে বেছে চীনা অর্থায়নে প্রকল্প গ্রহণ করি। যে প্রকল্প নেওয়া লাভজনক বলে মনে হয়, শুধু সেখানেই চীনা অর্থায়ন নেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, এক যুগ ধরে বাংলাদেশে ‘হায় হায় রব’ তৈরি করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যখন বিদ্যুৎ সংকট দূর করতে কর্মকৌশল প্রণয়ন করা হলো, তখন থেকেই বলা শুরু হলো যে দেশ রসাতলে যাবে, কিন্তু যায়নি। পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক চলে যাওয়ার সময়ও একটি শ্রেণি একই রকম করেছে, কিন্তু সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করছে। যখনই বড় কোন প্রকল্প নেওয়া হয়, তখনই একটি শ্রেণি তার বিরোধীতা করে।
‘স্বাধীন হলে বাংলাদেশ টিকবে না বলে মুক্তিযুদ্ধের সময়ই একটি পক্ষ সরব ছিল। তারা তখনও ভূল প্রমাণিত হয়েছে, তারা এখনও ভুল প্রমাণিত হচ্ছে,’ যোগ করেন তিনি।
কায়কাউস বলেন, ‘আমরা ভুল করতে পারি, পা পিছলে যেতে পারে; কিন্তু আমাদের গতিপথে কখনও পরিবর্তন আসেনি।’
‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আমরা যখন বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে গর্বিত ও উল্লসিত, তখন বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করে জাতীয় অর্জনকে এভাবে অবদমন করলে তার চেয়ে লজ্জাকর ও হাস্যকর কিছু হতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিম জানান, অনেকেই এনবিআরের রাজস্ব ছাড় দেওয়াকে শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করছেন। তারা বলছেন যে, রাজস্ব ছাড় দেওয়ার কারণেই শ্রীলঙ্কার অবস্থা করুণ হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা শ্রীলঙ্কার মতো রাজস্ব ছাড় দিচ্ছি না। এনবিআর রাজস্ব সমন্বয় করছে। আমরা অন্ধের মতো রাজস্ব ছাড় দিচ্ছি না। যেখানে রাজস্ব ছাড় দিলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে এবং পরবর্তীতে আরও বেশি রাজস্ব আদায় হবে—সেখানে সতর্কতার সঙ্গে রাজস্ব ছাড় দিচ্ছে এনবিআর।’
এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘একসময় রেডিও, টিভি, ফ্রিজ, এসিসহ ইলেক্ট্রনিকস আইটেম আমদানিনির্ভর ছিল। রাজস্ব ছাড় দেওয়ার কারণে এসব পণ্য এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে এবং দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ অভ্যন্তরীণভাবে মেটানো হচ্ছে। এ খাত থেকে এখন ভিন্নভাবে বেশি রাজস্ব আয় হচ্ছে। কর ছাড় দেওয়ার কারণে দেশে এখন ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ফোর হুইলার উৎপাদনে বিনিয়োগ হচ্ছে।’
সৌজন্যেঃ দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড