বাআ॥ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একটি ঈদ এসেছিল বাঙালির জীবনে। দীর্ঘ একমাস রোজা শেষে নভেম্বরের ২০ তারিখের সেই দিনটি ছিল শনিবার। মুসলিমদের জন্য সংযমের মাস হলেও, সেই রমজান জুড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অসহায় নারী-পুরুষদের ওপর নৃশংস তাণ্ডব চালায় জামায়াত, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা।
জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাড়ি-ঘরেও লুটপাট এবং অগ্নি সংযোগ করে হানাদাররা। আগুনের লেলিহান শিখা ও কালো ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে বাংলার আকাশ। এমনকি কোথাও কোথাও রাজাকারদের হাতে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয় মা-বোনেরাও।
জামায়াত আমির গোলাম আযমের নেতৃত্বে ঈদের দিন গণহত্যা
১৯৭১ এর নভেম্বর। সেই রমজান মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা মহিউদ্দীন হায়দার খোকা (কবি সুফিয়া কামালের নাতি) এবং জনপ্রিয় সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলসহ আরো অনেককে গ্রেফতার করে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলে ঢোকায় পাকিস্তানিরা। ঈদের দিন সেই জেল পরিদর্শনে যায় জামায়াতের আমির গোলাম আযম। খোকার পরিচয় শোনার পর তাকে লাথি মারে সে। এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষক বাশার খানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মহিউদ্দীন হায়দার খোকা জানান, ঈদের দিন অন্যান্যদের সঙ্গে তাকেও গুলি করে মেরে ফেলার কথা ছিল। কিন্তু যে ট্রাকে করে বন্দিদের নিয়ে যাওয়া হয়, সেই ট্রাকে আর জায়গা না থাকায় সেদিন প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
গোলাম আযমের বর্বরতার ব্যাপারে তিনি আরো বলেন, ‘সেদিন (ঈদের দিন) জেলখানায় আরেক বন্দি শহিদ নজরুলের দাঁড়ি টেনে ধরেছিল গোলাম আযম। তারপর বলেছিল- শেখ মুজিবের মৃত্যুদণ্ড হবে, তোদেরও সবকটাকে গুলি করে মারা হবে। এরপর গোলাম আযম বিভিন্ন সেল পরিদর্শন শেষে একটা বেঞ্চে বসলো। আর তার সাথে থাকা পেয়ার মিয়া আঙ্গুল দিয়ে যাদের দেখিয়ে দিলো, তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। মাগরেবের পর আর্মির দুটো ট্রাকে প্রায় ৫৭-৫৮ জনের মতো বন্দিকে তোলা হলো। নজরুলকেও নিয়ে যায় তারা। জায়গা না থাকায় আমিসহ বাকি ১০-১১ জনকে আর তুলতে পারেনি ট্রাকে। পরদিন জমাদার জানালো যে- সবাইকে পৈরতলা খালপাড়ে নিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়েছে।’ এদের হত্যার আগে পুরো রমজান মাসজুড়েই অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দেওয়া হয় রেলব্রিজ সংলগ্ন পৈরতলা খালে।
একাত্তরের ঈদের দিনের মর্নিং নিউজ ও দি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার সংবাদের বরাত দিয়ে বাশার খান তার ‘একাত্তরের ঈদ’ গ্রন্থে জানান, ঈদকে কেন্দ্র করে রাজাকারদের জন্য বিশেষ পুরস্কার ঘোষণা করেছিল পাকিস্তান সরকার। ফলে নতুন উদ্যমে ঈদের দিন আপামর বাঙালির ওপর পাশবিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও গণহত্যায় মেতে ওঠে রাজাকার এবং পাকিস্তানিরা। বাঙালি রাজাকারদের জন্য পাকিস্তানি সেনাদের মতো রেশন ব্যবস্থা চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। এমনকি রাজাকারদের বেতন বৃদ্ধি করে তাদের পদ অনুসারে ৭৫, ১৩৫ ও ৩০০ টাকা পর্যন্ত উন্নীত করা হয়।
ঈদের সুযোগে অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা
কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটি ছিল দুটি। ঈদকে কেন্দ্র করে তাদের অনেকে বাড়ি যায়, বাকিরা ঘুমিয়ে পড়ে। সবার ধারণা ছিল, ঈদের দিন তো আর কেউ হামলা করবে না। কিন্তু রাজাকারদের মাধ্যমে সেই তথ্য পায় পাকিস্তানিরা। এরপর শীতের ভোর রাতে ওই দুই ঘাঁটি (গোয়ালমারী চৌধুরী বাড়ি ও প্রাইমারি স্কুল) আক্রমণ করে পাকিস্তানিরা। কিন্তু এক গৃহহীন পাগলির (ইনসান পাগলি) পাকিস্তানিদের আগমন বুঝতে পেরে চিৎকার করে মুক্তিযোদ্ধাদের জাগিয়ে তোলেন। ততক্ষণে পাকিস্তানিরা গুলি শুরু করলেও, নিরাপদে প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হন মুক্তিযোদ্ধারা। আর মধ্যরাতেই অন্যগ্রামে (সোনাকান্দা) চলে যাওয়ায় বেঁচে যায় প্রাইমারি স্কুল ঘাঁটির মুক্তিযোদ্ধারাও।
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলাতেও ঈদের দিন ভোরে পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুুদ্ধ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। সকাল ৭টায় সেই যুদ্ধ জয়ের পর ঈদের নামাজ পড়েন মুক্তিযোদ্ধারা।
এদিকে রমজান মাসজুড়ে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে নারীদের ধরে নিয়ে যেতো। ক্যাম্পে আটকে রেখে নারীদের ধর্ষণ ও নির্যাতন চালাতো তারা। খুলনার বাটিয়াঘাটি থানার বারোয়ারী বাজারেও রাজাকারদের এরকম একটি ক্যাম্প ছিল। ১৯৭১ সালের ঈদুল ফিতরের দিন সেখানে অভিযান চালিয়ে, রাজাকারদের সঙ্গে যুদ্ধ করে, নির্যাতিত বন্দি নারীদের মুক্তি করে মুক্তিবাহিনী। সাবেক যুগ্ম-সচিব ও মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব আলমের মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গণ গ্রন্থে তিনি এই অভিযানের কথা বিস্তারিত লিখেছেন।
রক্তিম চাঁদের ঈদ ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের বর্বরতা
ধর্মের দোহাই দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর আবেগ ব্যবহার করে একদা যে দেশ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই দেশের মাটিতেই ঈদের দিনেও বাঙালি মুসলমানদের হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। ধর্মীয় পবিত্রতা ও উৎসবের এই দিনটিকে টার্গেট করেই পাশবিক হামলার ছক সাজিয়েছিল ধর্মব্যবসায়ী রাজাকার ও পাকিস্তানিরা। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ডায়েরি থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর ছিল জুমাতুল বিদা, শেষ রোজার দিন। রোজা রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে থমথমে পরিবেশে জুমার নামাজ আদায় করেন তিনি। এরপর বিকালে শুনতে পান বোমার শব্দ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম নারী ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানা নিনা যুদ্ধের ৯ মাসই ছিলেন ঢাকাতে। তিনি সেবারের ঈদের ব্যাপারে একাত্তরের ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘ঈদের তিন দিন বাকি আছে। কারো মুখে আনন্দ নেই। বিকাল পাঁচটায় শহরে কারফিউ জারি করা হলো।’ এরপর এলাকায় এলাকায় রাজাকার ও পাকিস্তানিদের তল্লাশি শুরুর কথাও জানা যায় তার লেখায়। ঢাকার পরিবেশ যে কতোটা ভয়াবহ ছিল তা বোঝা যায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখায়। তিনি ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘ঈদের কোনো আয়োজন নেই বাসায়। শরীফ, জামি ঈদের নামাজও পড়তে যায়নি।’
কমিউনিস্ট নেতা আবদুল গফুরের মেয়ে ও পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক উপপ্রধান জেবুননেছা জুবি সেই ঈদ সম্পর্কে গৌরবের একাত্তর নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘৩ অগ্রহায়ণ (২০ নভেম্বর)। বিছানা ছেড়ে ওঠার আগেই কামানের শব্দ শোনা গেল। চারদিকে যেনো করুণ সুর বাজছে। তবে হাতে গোণা কয়েকটি পরিবার এবার বেশি আনন্দ করছে। ওরা কি বাঙালি! ওদের কী মনুষ্যত্ব আছে!’
সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীন তার স্মৃতিকথায় ঢাকার ঈদের ব্যাপারে লেখেন, ‘বেলা ৩টা পর্যন্ত শহর জনশূন্য। ২৭ মার্চ শহর যেমন জনশূন্য ছিল, আজও তেমন।’ ১৯৭১ সালের পত্রিকাগুলো থেকে সেই ঈদের ব্যাপারে জানা যায়, প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথায় মুহ্যমান ছিল সেই ঈদ। উৎসবের আমেজ নেই। ক্ষোভে, দুঃখে মানুষের তিতিক্ষা দ্বিগুণতর। শোকাবহ পরিবেশে পালিত হয় সেই ঈদ।
কেউ হারিয়েছেন স্ত্রী, কেউ হারান মাতা-পিতা, কেউ হারায় সন্তান; কারো হারায় সম্পদ ও সম্ভ্রম। তবে সব লুট করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা। ১৯৭১ সালের ঈদুল ফিতরের ঈদ ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোশ নগ্নভাবে খুলে দিয়েছে আপামর জনতার সামনে।