প্রশান্তি ডেক্স॥ স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যেভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে গড়তে চেয়েছিলেন, আজ বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে সেই অবস্থানে পৌঁছে গেছে দেশ। ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত, মানবিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী সমাজ গঠনই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন। যেজন্য দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন তিনি। দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রাম, স্বাধীনতা যুদ্ধ ও স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছর বঙ্গবন্ধুর দেশ পুনঃনির্মাণের জন যে পরিকল্পনা ও অক্লান্ত শ্রম দিয়েছেন, সবকিছুই পাশে থেকে দেখেছেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যার পর নির্বাসিত জীবন যাপন করতে হয় তাকে। এরপর ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের প্রধান নির্বাচিত হওয়ার পর দেশে ফিরেও পদে পদে মোকাবিলা করতে হয় নানামুখী প্রতিবন্ধকতা। মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু হাল ছেড়ে দেননি তিনি। যার ফলশ্রুতিতেই আমরা পেয়েছি আজকের বাংলাদেশকে।
একদিকে স্বৈরশাসকদের কবল থেকে গণতন্ত্র রক্ষা, অন্যদিকে সারা দেশ ঘুরে গণমানুষের জীবন পাঠ করা- এই দুই মহাযজ্ঞের মধ্য দিয়েই ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। হৃদয়ে এবং নিউরনে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শনকে আঁকড়ে ধরে এবং তা বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা থেকে এই দুর্গম যাত্রপথ অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আন্তর্জাতিক জার্নালে লেখা একটি প্রবন্ধে এসব বিষয়ে বিস্তারিত তুলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।
যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপ এবং স্বৈরাচার ও উগ্রবাদের কড়াল গ্রাস থেকে মানুষকে মুক্ত করে আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথযাত্রা হিসেবে তিনটি বিশেষ ধাপের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। সেগুলো হলো:
প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ উপলব্ধি ও ধারণ করে তা বাস্তবায়নের সংগ্রাম।
দ্বিতীয়ত, জনগণের সাতটি মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য পরিকল্পনা ও অক্লান্ত শ্রমের মাধ্যমে বা বাস্তবায়ন করা।
তৃতীয়ত, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনমান আধুনিক পৃথিবীর উপযোগী করে তোলার জন্য দেশকে প্রস্তুত করা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার লেখা ‘স্ট্রাইভিং টু রিয়ালাইজ দ্যা আইডিয়ালস অব মাই ফাদার’ শিরোনামে লেখা সেই প্রবন্ধের শুরুতেই স্মৃতিচারণ করেছেন তার পিতার এক মর্মস্পর্শী উদ্ধৃতি দিয়ে। স্বাধীনতার পর দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও বঙ্গবন্ধু তার পরিবারকে কতোটা সাধারণ জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করতেন, তারই প্রতিফলন ঘটেছে এই স্মৃতিচারণায়। তরুণী বয়সের চপলতায় উচ্ছ্বসিত কন্যা শেখ হাসিনার দামি কাপড় পড়া দেখে বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কী এই সময়েও চাকচিক্যময় দামি শাড়ি ও গহনা পরবে? বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের যেখানে এক বেলা খাবারও জোটাতেও কষ্ট হচ্ছে, সেখানে তুমি কী সেখানে দেখাতে চাও যে- তুমি কতটা অবস্থাসম্পন্ন? দয়া করে এসব দামি জিনিস পরবে না, সাধারণ কিছু পরিধান করবে, যাতে তুমি এই দেশের দরিদ্র মানুষদের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে পারো, তাহলেই তুমি তাদের অনুভূতি উপলব্ধি করবে।”
বঙ্গবন্ধুর এই বাণী আজো কানে বাজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন- আমি আমার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সেই কথাগুলো কখনোই ভুলতে পারি না, যাকে জনগণ ভালবেসে বঙ্গবন্ধু বা বাংলাদেশের বন্ধু বলে ডাকে। ১৯৬০-এর দশকে তাকে এই উপাধি দেওয়া হয়েছিল, যার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয় যে- জনগণ তাকে কতটা ভালবাসতো। এটি শুধু কোনো উপাধি ছিল না, বরং এটি হলো গণমানুষের ভালোবাসার প্রতিফলন। কীভাবে বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হয় এবং তাদের জন্য কীভাবে একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়তে হয়– তা আমি আমার পিতার কাছ থেকে শিখেছি। প্রাচীনকালে আমাদের এই ভূমি যেমন ‘সোনার বাংলা’ নামে পরিচিত ছিল, ঠিক তেমনি আবারো এই বাংলাদেশকে তিনি ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। গণতন্ত্র, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শের ভিত্তিতে তিনি একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এটি শেষ পর্যন্ত তার রাজনৈতিক দর্শন হয়ে উঠেছিল এবং সারা জীবন সেই আলোকিত চেতনাই লালন করেছেন তিনি। আমি সবসময় তার পরামর্শ ও কাজের উদাহরণগুলো অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি।
শেখ মুজিবুর রহমানের তিনটি বিশেষ ব্যক্তিগত গুণ:
শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সব বাঙালি পরিবারের মতোই একটি সাধারণ পরিবারের সন্তান ছিলেন বলে অভিহিত করেছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। কাছে থেকে দেখা পিতার জীবনবোধ সম্পর্কে তিনি আরো জানান: কিন্তু তার (বঙ্গবন্ধুর) মধ্যে কিছু অনন্য-সাধারণ গুণ ছিল। অন্যতম তিনটি গুণ হলো-
প্রথমত, তিনি সহজাতভাবে সমাজের সর্বোস্তরের মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন এবং মানুষের প্রতি তিনি সর্বদাই খুব সহানুভূতিশীল ছিলেন। তার পারিবারিক পরিবেশের কারণেই সম্ভবত এটি সম্ভব হয়েছে। কারণ তিনি খুব উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পদশালী পরিবারের সদস্য ছিলেন না, তিনি ছিলেন গ্রামের আর্থিকভাবে স্বচ্ছল কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান।
দ্বিতীয়ত, তিনি ছিলেন স্বভাগতভাবেই খুব প্রতিবাদী এবং যে কোনো নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার।
তৃতীয়ত, গণমানুষের চাওয়া-পাওয়ায় বিষয়টি তিনি খুব সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারতেন এবং তাদের দাবির জন্য স্পষ্টভাবে আওয়াজ তুলতেন। মানুষ তার মধ্যে নিজেদের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেতেন। ফলে নির্দ্বিধায় জনগণের আস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন তিনি।
ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা:
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর, ১৯৪৮ সালেই শুরু হয় মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার আন্দোলন। তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তার নেতৃত্বেই সংগঠিত হতে থাকে ছাত্র-ছাত্রীরা এবং এই আন্দোলন ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলা ভাষার দাবির আন্দোলন থেকে তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সঙ্গীদের গ্রেফতার করে পাকিস্তানি শাসকরা। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে এরপর আরো একাধিকবার জেল-জুলুম সহ্য করতে হয় ছাত্রনেতা শেখ মুজিবকে।
গণমানুষের ভালোবাসা এবং আকাঙ্ক্ষার কারণেই তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান ক্রমেই জননেতা হয়ে ওঠেন। প্রায় দুই যুগের কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে দেশের তৃণমূলের প্রতিটি মানুষের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে যান নেতা মুজিব। দেশের প্রতিটি প্রান্তে জনগণের সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকে ছড়িয়ে দেন তিনি। দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম এবং জনগণের ভালোবাসা অর্জনের মাধ্যমে, বাংলার সব ধর্ম-বর্ণ-পেশার মানুষকে এক ছাতার নিচে আনতে সমর্থ হন বঙ্গবন্ধু। বহুধাবিভক্ত সাত কোটি বাঙালিকে প্রথমবারের মতো এক জাতি হিসেবে মিলিত করেন তিনি। ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার ওপর ভিত্তি করে একচেটিয়াভাবে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ভোট দেয় আপামর বাঙালি।
কিন্তু পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা শুরু করে ষড়যন্ত্র। খেয়াল করে দেখবেন- বাংলা ভাষার জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার সিকি-শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে ন্যায্য অধিকার আদায়ে স্বায়ত্ত্বশাসনের জন্য তীব্র আন্দোলন শুরু হয়, যা চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায়, অবশেষে চূড়ান্ত মুহূর্ত চলে আসে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক গণসমাবেশে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি জান্তাদের বর্বর নিষ্ঠুরতা এবং স্বাধীনতার জন্য জনগণের স্বস্তঃস্ফূর্ত আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তিনি।
ফলে দখলদার পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে নেমে পড়ে বাঙালি জাতি। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ দুই যুগের মতো সময় ধরে যে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম হয় নতুন রাষ্ট্রের, অভিধানে যুক্ত হয় ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি দেশ।
বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ বাংলাদেশের এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা:
রাজনৈতিক জীবনের পুরো সময়জুড়ে শেখ মুজিবুর রহমান অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে লক্ষ্য অর্জনের পথ বেছে নিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বাংলাদেশজুগে গণহত্যা শুরুর পরপরই পাকিস্তানি সেনারা তাকে গ্রেফতার করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নিঃসঙ্গ কারাগারে বন্দি করে রাখে।
এবিষয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন: কারাগার-প্রাঙ্গণে বসানো একটি গোপন বিচারের মাধ্যমে আমার বাবাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় পাকিস্তানিরা। বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করে, তখন তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয় জান্তারা। এর আগেও, জীবনে বারবার কারাবরণ করার কারণে আমিসহ আমার ভাই-বোনেরা বাবার উপস্থিতি ও স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। কিন্তু তার হৃদয়ের আদর-স্নেহ থেকে আমরা সবসময়ই উপলব্ধি করেছি। বাবার রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি সময়ই আমার মা তাকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। বাবার অবর্তমানে নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে মা আমাদের দেখে রাখতেন, আমাদের সুশিক্ষার ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন তিনি। আমরা আমাদের বাবাকে খুবই মিস করতাম। তাই তার অনুপস্থিতি প্রতিনিয়তই আমাদের মনে তার আদর্শের প্রতি তীব্র আনুগত্য ও অনুরাগ সৃষ্টি করে।
আমরা সচেতনভাবেই উপলব্ধি করতাম যে- বাবাকে তার আদর্শের জন্যই জেলে যেতে হয়েছে, সেজন্যই তিনি আমাদের সঙ্গে থাকতে পারেন না অধিকাংশ সময়। তার এই আত্মত্যাগকে আমরা হৃদয়ে ধারণ করি। বাবার আত্মত্যাগের কারণ উপলব্ধি করার ফলেই আমরা ত্যাগের মানসিকতা ধারণ করে বেড়ে উঠেছি।
বাবা-মা আমাদের দেশপ্রেম ও মূল্যবোধ সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছেন। দেশের স্বাধীনতা ও মানুষের প্রতি বাবার গভীর ভালোবাসাকে আমরা সবসময় হৃদয়ে ধারণ করি। বাবা-মার আত্মত্যাগ ও তাদের শিক্ষার কারণেই কখনো পথ হারানোর ভয় নেই আমাদের। এমনকি একারণেই দেশ এবং মানুষের সুন্দর ও উন্নত ভবিষ্যত নির্মাণের ব্যাপারে কোনো প্রতিবন্ধকতাই আমাদের আশাহত করে না।
অনিঃশেষ প্রতিবন্ধকতা ও সোনার বাংলা গঠনের প্রথম পর্ব:
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে শেখ হাসিনা আরো লিখেছেন- বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর, অবশেষে আমার বাবাকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি সেনারা। তিনি বিজয়ীর বেশে দ্রুত ঢাকা ফিরে আসেন। এবং তার প্রিয় জনগণ তাকে জাতীয় বীর হিসেবে অভিনন্দিত করে এবং বাঁধভাঙা আনন্দঅশ্রু-মথিত আবেগে বরণ করে নেয় তাকে।
এরপর সরকারপ্রধান হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনরায় গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন জাতির পিতা। তখন সরকারি কোষাগার ছিল খালি। কিন্তু দেশ পুনর্গঠনের কাজ এক মুহূর্ত থামিয়ে রাখেননি তিনি। পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুর নিপীড়ন থেকে প্রাণ বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রয় এক কোটি শরণার্থীকে দেশে ফেরানো এবং তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা; দেশের ধ্বংসপ্রাপ্ত রেললাইন, সড়ক ব্যবস্থা, ব্রিজ-কালভার্ট সংস্কার ও নির্মাণ করা, ভেঙে পড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুত সচল করতে হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় নাগরিকরা স্বপ্রণোদিত হয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করে যুদ্ধ করেছেন যারা, সেসব অস্ত্র উদ্ধার করা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার ব্যাপারটিও হয়ে উঠেছিল গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া কৃষিক্ষেত্রের ফসল উৎপাদন ব্যবস্থা ঠিক করা এবং প্রয়োজনীয় কৃষিজপণ্যের সরবরাহ বাজারে নিশ্চিত করার মতো কাজ অবশ্যাম্ভী হয়ে পড়ে।
স্থানচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসন, ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পুনর্স্থাপন, অস্ত্র উদ্ধার- সবকিছু মিলিয়ে একটা ব্যস্ত ও অস্থির সময় যাচ্ছিলো তখন। ঠিক এরকম একটি সময়ে দেশকে সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা কমিশন গঠন করলেন বঙ্গবন্ধু। এই কমিশন ব্যাপক পরিসরে দেশ গঠনের পরিকল্পনা হাতে নেয়। এসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা, যার মাধ্যমে মুক্তিকামী মানুষের মানবিক ও অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। যা পাওয়ার জন্য মানুষ দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, তাদের সেই লক্ষ্য পূরণ করা।
এছাড়াও স্বাধীনতার পরপরই প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদায়ের প্রতি গুরুত্ব দেন শেখ মুজিব। তিনি বিশ্বের অন্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর কাছে বাংলাদেশকে জরুরি কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান ও চেষ্টা করেন। এবং একজন ক্যারিসম্যাটিক নেতা হিসেবে খুব স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই অধিকাংশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করতে সমর্থ হন তিনি। একই সঙ্গে স্থিরলক্ষ্যের ও সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বগুণের কারণে একজন বিশ্বনেতা হিসেবে সমাদৃত হন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান। অনেক খ্যাতিমান ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রনেতারা সেসময় ঢাকায় আসেন এবং বঙ্গবন্ধুকেও তারা আমন্ত্রণ জানান। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর কারণেই বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয় বাংলাদেশের নাম।
১৯৭৫ এর বিয়োগান্তক অধ্যায় ও শেখ হাসিনার শরণার্থী জীবন:
১৯৭৫ সালের সেই ট্রাজেডির কথা স্মরণ করে জননেত্রী শেক হাসিনা লেখেন: সেই ট্রাজেডি এখনো আমাকে শোকাহত রাখে, সেই নির্মম অমানবিক ঘটনাটির রেশ এখনো কাটেনি আমাদের মন থেকে। সেই সময় পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে আমার স্বামী ড. ওয়াজেদ জার্মানিতে কর্মরত ছিলেন। সেকারণে আমার ছোট বোন রেহানা এবং আমার দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে সেখানে ঘুরতে গিয়েছিলাম আমি। পরিবারের সবাই মিলে ছোট্ট একটি ট্রিপ দিতে তখন অবস্থান করছিলাম বেলজিয়ামে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরের দিকে টেলিফোনের কর্কশ শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। যাদের বাসায় আমরা উঠেছিলাম, তিনি ফোনটি ধরলেন। কিন্তু এরপর তিনি আমার সঙ্গে আর কথা বলতে চাইলেন না। আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বললেন তিনি। আমার স্বামী তখন আমার নিকটেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর আমার স্বামী আমার দিকে ঘুরে তাকালেন এবং বললেন- বাংলাদেশে একটি অভ্যুত্থান হয়েছে। তখন এর বেশি আর কিছুই বললেন না তিনি। কিন্তু তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে আমি অনুভব করলাম- ঢাকায় আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভয়ানক কিছু ঘটে গেছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি শোকাহত এবং বিমূঢ় হয়ে পড়ি। আমার মুখ থেকে তখন একটি কথাই বের হয় শুধু, তা হলে- যদি কোনো অভ্যুত্থান হয়ে থাকে, তাহলে আমি সবাইকে হারিয়ে ফেলেছি। এরপর জার্মানির বনে রাষ্ট্রদূত হুমায়ন রশীদ চৌধুরীর বাড়িতে যাই আমরা। তখনই জানতে পারি হৃদয়বিদারক ঘটনাটি। আমার বাবা-মা, নববিবাহিত দুই ভাই ও তাদের স্ত্রী, এমনকি আমার শিশু-ভ্রাতা রাসেলকেও হত্যা করা হয়েছে। সেই বর্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ ১৮ জনের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে আমার হৃদয় এখনো কান্নায় ভিজে যায়।
এরপর খুনিরা রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখল করায়, আমি ও আমার বোনের দেশে ফেরার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। দুই শিশু সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ ছয় বছর মানবেতর পরিস্থিতিতে নির্বাসিত জীবনযাপন করি আমরা। ঘাতকদের গুপ্ত হামলার আতঙ্ক বুকে চেপে প্রতিনিয়তই শরণার্থী হিসেবে বিভিন্ন স্থানে ছুটতে হয়েছে আমাদের।
বঙ্গবন্ধুকন্যার বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন ও ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক পথযাত্রা:
দীর্ঘ অর্ধযুগ মানবেতর নির্বাসন শেষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন: ১৯৮১ সাল, নির্বাসিত জীবনের অন্ধকার-সুরঙ্গের শেষপ্রান্ত থেকে যেনো একটুখানি আলো রেখা দেখলাম। ১৯৫০ এর দশকে আমার বাবা যে রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই দল আমাকে তাদের সভাপতি নির্বাচিত করলো, সারা দেশের মানুষ স্বাগত জানালো দলের এই সিদ্ধান্তকে। তৎকালীন সামরিক সরকারের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এরপর আমি (১৯৮১ সালে) বাংলাদেশে ফিরে এলাম। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার কন্যা হওয়ার পরেও, দেশে ফেরার পর আমার রাজনৈতিক পদচারণা সহজ ছিল না। প্রতিটি ধাপে ধাপে ছিল বিভিন্ন সমস্যা, ঝুঁকি ও প্রতিবন্ধকতা। তবুও ওই ভয়াবহ সময়ে আমি আমার যাবতীয় আবেগ এবং শক্তিকে এক করে রাজনীতিতে মনোনিবেশ করি। ঝুঁকি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর বিকল্প কিছু ভাবিনি আমি, আমার বাবা থাকলেও হয়তো তাই করতেন।
আমাদের দিকে যেসব প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ আসতে থাকলো, আমি সেগুলো মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। শুধু আমার পিতাসহ পুরো পরিবারকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার বিচার করার জন্য আমি এতো সংগ্রামের পথ বেছে নেইনি। সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া খুনিদের চাইতেও নেপথ্য-ষড়যন্ত্রকারীদের অপরাধের মাত্রা আমার কাছে ছিল আরো বেশি, কারণ তারা এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শত বছরের ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হওয়া একটি নতুন রাষ্ট্রের এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নকেও হত্যা করেছে।
সেই সময় অনেক রকম কঠিন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে, আমি একটি খুব সহজ তত্ত্ব অনুসরণ করি। আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘আমার বাবা শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে এই পরিস্থিতিতে কী করতেন?’ প্রতিবারই আমি উত্তরে পেয়েছি- ‘বাংলাদেশের আদর্শের প্রতি অবিচল থাকতে হবে, যে আদর্শ আমার বাবাকে এবং পুরো জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যেই আদর্শের জন্য ৩০ লাখ মানুষ তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, সেই আদর্শের প্রতি আমাদের বিশ্বস্ত থাকা প্রয়োজন।’
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আদর্শ বাস্তবায়নের পথে শেখ হাসিনার নতুন যাত্রার অভিজ্ঞতা:
দেশে ফেরার পর, মানুষের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়গুলো জানার জন্য; বিশেষ করে সুবিধবঞ্চিত মানুষ যারা, তাদের জীবনের সমস্যাগুলোকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখা এবং চিহ্নিত করার জন্য দেশ পরিভ্রমণের কথাও উল্লেখ করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি লেখেন, গণমানুষের ভবিষ্যৎ জীবনের আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্নের কথাগুলোও জানতে চেষ্টা করি। আমি নিয়মিতভাবে দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা শুরু করি।
বিশেষ করে গ্রামের সংখ্যা গরিষ্ঠ সাধারণ ও স্বল্প আয়ের মানুষদের সঙ্গে কথা বলি, প্রকৃতপক্ষে তারাই তো বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি। এজন্য তাদের জীবন ও মনকে জানার জন্য আমি গ্রামের পর গ্রামে যেতে থাকি, গ্রামের বাজার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করি। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আমি প্রথমবারের মতো গ্রামীণ অর্থনৈতিক কার্যাবলীর সঙ্গে পরিচিত হই এবং তাদের প্রয়োজনগুলো বুঝতে পারি। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়; যেমন- বন্যা, সাইক্লোন প্রভৃতির সময় তাদের কী দরকার, তা উপলব্ধি করি।
এই সময়েই আমি মঙ্গা কবলিত এলাকাগুলো চষে বেড়াই (বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের স্থানীয় দুর্ভিক্ষকে মঙ্গা বলা হয়, যার প্রভাব পড়ে পুরো উত্তরবঙ্গের মানুষের ওপর)। এবং প্রতিবছর এই মঙ্গা সৃষ্টির প্রকৃত কারণ জানার চেষ্টা করি। আমার স্মৃতিজুড়ে আলোড়ন তুলে যায় বাবার স্বপ্নের কথা, এই দেশের উন্নয়নের জন্য বাবার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাগুলোর কথা। বাবা প্রায়ই আমাদের সঙ্গে তার পরিকল্পনাগুলো শেয়ার করতেন। তিনি বলতেন- কীভাবে ঔপনিবেশিক আমল থেকে সৃষ্ট দারিদ্র্যের কষাঘাতে বিপর্যস্ত দেশ থেকে দারিদ্র্য মুক্ত করা যাবে। এটি নিয়ে তার বিস্তর পরিকল্পনা ছিল।
আমি এটাও বুঝতে পারি যে- দলেক অনেক নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, এরপর ১৯৭৫ সালের পর থেকে দল পড়ে গেছে নেতৃত্ব সংকটে, ফলে দেশ পুনর্গঠনের জন্য শেখ মুজিবের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে পদ্ধতিগতভাবে একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। একারণে আমি আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করার উদ্যোগ নেই। কিন্তু এই ক্ষেত্রেও কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় আমাকে। অনেকে আমাকে বলতে শুরু করেন- যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক, আমাদের অতো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন নাই।
কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম, রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে দলটিকে আরো শক্তশালী করা প্রয়োজন। তাই তৃণমূলের সবচেয়ে ছোট ইউনিট থেকে দল পুনর্গঠনের কাজ শুরু করি আমি। তবে এটি ছিল যথেষ্ট কঠিন, শ্রমসাধ্য এবং একটি প্রতিষ্ঠান নবনির্মাণের কাজ। দলকে এই পরিবর্তন ও পুনর্গঠনের জন্য প্রস্তুত করার ক্ষেত্রেও শেখ মুজিবের আদর্শ, দর্শন এবং আকাঙ্ক্ষাগুলো অনেক সাহায্য করেছে। তৃণমূলের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততার কারণেই দেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং দেশের সংবিধানের মূলনীতিগুলোর ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে।
বাংলাদেশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা–চেতনার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা:
আমার বাবার আইডিয়াগুলোকে আমি দেশ গঠনের জন্য বাস্তব কর্মসূচিতে পরিণত করতে পেরেছি। কারণ দেশকে নিয়ে আমার বাবার সারা জীবনের চিন্তা-চেতনা এবং পরিকল্পনাগুলোর ব্যাপারে আমার জানাশোনা ছিল এবং বাবার সংস্পর্শে থাকার কারণে বিষয়গুলো আমি বুঝতে শিখেছিলাম। ফলে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের জন্য বাবার দর্শন বাস্তবায়ন করতে সুবিধা হয় আমার। বাবার যে মূলনীতিগুলো আমাকে সবসময় পথ দেখিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- (১). সবসময় অবিচল থাকা, (২). সহানুভূতিশীল থাকা, (৩). কর্মপদ্ধতি ঠিক করা এবং (৪). তা বাস্তবায়ন করা।
আমার বাবার স্বপ্ন ছিল একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সর্বোস্তরের মানুষের জন্য উন্নত জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে এবং তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। তিনি যখন বাড়িতে থাকতেন, প্রায়ই তিনি দেশ ও মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বিষয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা আলোচনা করতেন আমাদের সঙ্গে। কীভাবে কৃষিভিত্তিক উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে প্রত্যেকটি গ্রামকে স্বনির্ভর করে তোলা যায়- সেই বিষয়ে তিনি বলতেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন- দেশে আধুনিক শিল্পায়ন, সড়ক-নির্মাণ, নদী খনন, রেল সংযোগের পরিধি বাড়ানো, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ বহুমুখী ক্ষেত্রে দ্রুত দেশকে পুনর্গঠিত করার।
বঙ্গবন্ধু চাইতেন- প্রতিটি গ্রামে গ্রামে ধানের জমির পাশ দিয়ে ভালো সড়ক হবে, যাতে কৃষকদের প্রতিষ্ঠা পেতে সুবিধা হয়। এছাড়াও গ্রামে গ্রামে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক জীবনের প্রয়োজনীয় সব সুবিধা গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। কৃষিজ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষি ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে চাইতেন তিনি। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা সমবায়ের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত বিভিন্ন মেশিন কিনে সেগুলো কাজে লাগানোর ওপর চিন্তা করেছিলেন।
তিনি কৃষি ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার আনতে চেয়েছেন। উৎপাদন-বণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি সরকারি সহায়তার মাধ্যমে সমবায়ভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা গড়তে চেয়েছিলেন। যেখানে ফসল তিন ভাগে ভাগ হতো; (১). জমির মালিক পেতেন এক ভাগ, (২). কৃষকরা পেতেন এক ভাগ এবং (৩). রাষ্ট্রীয় সমর্থনপুষ্ট সমবায় সমিতি পেতো অবশিষ্ট এক ভাগ। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য ন্যায্য মূল্যে বিক্রির জন্য বাজারব্যবস্থা সংস্কারের পরিকল্পনাও করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, আমার বাবা বিশ্বাস করতেন যে বিভিন্ন উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশের পরিস্থিতি উন্নতি করা সম্ভব। তার এসব চিন্তা-চেতনা এবং বিশ্বাসগুলোই আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এবং অনুপ্রেরণা।
শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হয়েছে, তাই আজকের বাংলাদেশ গঠন সম্ভব হয়েছে:
১৯৭৫ সালের সেই কালরাতে পরিবারের সবাইকে হারানোর বেদনা ভুলে থাকা এবং সেই মানসিক ধাক্কা থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব। তারপরও দেশের মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার জন্য পরিবার হারানোর শোককে শক্তি পরিণত করার চেষ্টা করেছেন বলে জানিয়েছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি লিখেছেন- শোককে শক্তিতে পরিণত করার মতো উদাহরণ পৃথিবীতে আরো কিছু দেখেছি। বড় ধরনের কোনো ক্ষতির পর পৃথিবীতে অনেক বিত্তশালী পরিবারের সদস্যরা মানবতার জন্য কল্যাণকর প্রতিষ্ঠান নির্মাণের জন্য তাদের সম্পদ অনুদান দিয়েছেন। ১৮৮৪ সালে পরিবারের একমাত্র শিশু সন্তান লিল্যান্ড জুনিয়র টাইফয়েডে মারা যাওয়ার পর স্টানফোর্ড পরিবার ৮ হাজার একরের বেশি ভূমি দান করেছে একটি ফাউন্ডেশনের জন্য, সেই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেই আজকের স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটি গড়ে উঠেছে।
তেমনি টাইটানিক ডুবির ঘটনার ১৯১২ সালে ওয়াইডেনার পরিবারের সন্তান হ্যারির মৃত্যুর পর, পরিবারের পক্ষ থেকে বড় ধরনের অনুদান দেওয়া হয় হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে, সেই অর্থেই বিশবিদ্যালয়টির সর্ববৃহৎ ও সর্বাধুনিক লাইব্রেরিটি গড়ে তোলা হয়, এটি এখন বিশ্বের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরি। আমি এই উদাহরণগুলোকে টেনে আনলাম কারণ এটা দেখানোর জন্য যে, কোনো দুঃখজনক তীব্র বেদনাদায়ক ঘটনার শোক থেকেও ভালো কাজের সূচনা হতে পারে।
আমি মনে করি যে, আমার পুরো পরিবার হারানোর ঘটনাটি একটি ভয়ানক বেদনাদায়ক ব্যাপার, কিন্তু মানবকল্যাণের লক্ষ্যে অনুদান দেওয়ার মতো সম্পদ আমার নেই। তাই আমার মনে হলো- আমার শোক, ব্যথা-বেদনা ও অশ্রুকে শক্তিতে পরিণত করে গণমানুষের বসবাসযোগ্য একটি সুন্দর বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য নিজেকে নিবেদিত করবো। ১৯৭৫ সালের পর থেকে টানা ২১ বছরের কষ্ট ও পরিশ্রমের ফল হিসেবে ১৯৯৬ সালে আমি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হই। মূলত, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরই দেশ প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। এরপর ২০০৯ সাল থেকে টানা তৃতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় উন্নয়নমূলক কাজের জন্য সময় পান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন বাস্তবায়নের মাধ্যমে তিনি তাই আজকের বাংলাদেশকে ডিজিটাল রাষ্ট্রে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রদর্শন, শেখ হাসিনার দূরদর্শী পরিকল্পনা ও অক্লান্ত শ্রমের কারণেই আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।