ভজন শংকর আচার্য্য, কসবা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি ॥ কসবায় পরকীয়ার জের ধরে ত্রিপুরায় নিয়ে মাদলা গ্রামের ডালিম নামক এক যুবককে হত্যার অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জুডিশিয়াল আদালতে মামলা করেছেন নিহতের মা সালমা আক্তার (৪০)। মা ও গ্রামবাসীর দাবী একই গ্রামের হাবিবুর রহমান শিমুলের স্ত্রীর সংঙ্গে ডালিমের প্রণয় থাকায় পরিকল্পিতভাবে ত্রিপুরার টাকারজলায় নিয়ে ওই যুবককে হত্যা করে। বিজ্ঞ আদালত এ বিষয়ে কসবা থানায় কোনো প্রকার মামলা হয়েছে কিনা ৭ দিনের মধ্যে অফিসার ইনচার্জকে জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আদালতে দায়েরকৃত অভিযোগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়; উপজেলার মাদলা গ্রামের সালমা বেগমের একমাত্র পুত্র ডালিম (২২)। একই গ্রামের মোহন মিয়ার সংঙ্গে বিবাহের পর ডালিম যখন তার মায়ের গর্ভে তখনই মোহন অন্য এক রমনীকে পালিয়ে বিয়ে করে সংসার গড়ে তোলে। নিরুপায় সালমা গার্মেন্টেসে চাকুরী করে ছেলেকে লালন পালন করে শ্বশুড়-শ্বাশুড়ির সহায়তায়। এক পর্যায়ে চাকুরী করে টাকা যোগাড় করে সালমা লেবাননে চলে যায় এবং একমাত্র ছেলের লেখাপড়া ও ভরণপোষনের খরচ পাঠায় শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে। সেখানে প্রায় ১৫ বছর চাকুরী করে গত বছর করোনাকালীন সময়ে দেশে ফিরে আসে সালমা।
স্বামীহারা সালমা একমাত্র পুত্রের দিকে তাকিয়ে বিয়ে করেনি। স্বপ্ন ছিল ছেলেকে নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন। করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাশ^বর্তী হানিফ মিয়ার পুত্র হাবিবুর রহমান শিমুল, জহিরুল ইসলাম ও একই গ্রামের শাহআলম মিয়ার পুত্র হৃদয়ের সংঙ্গে ডালিমের সখ্যতা গড়ে ওঠে। তখন সীমান্তবর্তী নয়নপুর গরু বাজারকে কেন্দ্র করে ভারতীয় গরুর রমরমা ব্যবসা। শিমুল, জহির ও হৃদয়ের সংঙ্গে গরুর ব্যবসায় যোগ দেয় ডালিম। ব্যবসাকে কেন্দ্র করে শিমুলদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল ডালিমের।
এক পর্যায়ে শিমুলের স্ত্রীর সংঙ্গে ডালিমের প্রণয় সৃষ্টি হয়। শিমুলের স্ত্রীর একটি চিঠি ডালিমের মা সালমার হাতে পড়লে বিষয়টি জানাজানি হয়। সালমা বেগম শিমুলদের বাড়ি গিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করেন এবং ডালিমকে যাতে তাদের বাড়িতে প্রশ্রয় না দেন তাদের অনুরোধ করেন।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিমুল তার স্ত্রীকে একাধিকবার মারধোর করেন। তবে ডালিমের সংঙ্গে তাদের ব্যবসায়ীক সম্পর্ক বহাল থাকে। প্রতিদিনই ডালিমদের ঘরে শিমুল, জহির ও হৃদয় আসা যাওয়া করতো। গরু, কাঁঠাল, আনারস ও অন্যান্য ব্যবসা নিয়ে কথাবার্তা বলতো।
গত ১০ জুন ছিলো শুক্রবার। বাড়ি থেকে মাত্র ৩০০ গজ দূরে ত্রিপুরার সীমান্ত। সীমান্তের ওপাড় থেকে বিকালে ২ ঘন্টার মধ্যে আনারস আনার কথা বলে ডালিমকে নিয়ে যায় জহির ও হৃদয়। কিন্তু ২ ঘন্টার মধ্যে ডালিম আর ফিরে আসেনি। ডালিমের মা সালমা বেগম জানান; সীমন্তবর্তী কোনাবন নামক স্থান থেকে ত্রিপুরার সিপাহীজলা জেলার টাকারজলা থানা এলাকায় জহির ও হৃদয় তাকে নিয়ে যায়। সেখানেই পরিকল্পিকভাবে পিটিয়ে হত্যা করে শিমুল, জহির, হৃদয় ও তার আত্মীয়রা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়; হাবিবুর রহমান শিমুল পাসপোর্টে আখাউড়া চেক পোষ্ট দিয়ে ঘটনার ৫/৬দিন আগেই ত্রিপুরার ওই এলাকায় তার ফুফুর বাড়িতে অবস্থান নেয়। ওই এলাকায় তার ফুফু ও খালার বাড়ি রয়েছে। (শিমুলের পাসপোট নং বিজিডি A02138160) হৃদয় ওই রাতেই ফিরে এলেও ডালিমের মাকে কিছুই জানায়নি। বরং ডালিমের মাকে এড়িয়ে চলে।
ইতোমধ্যে ভারতীয় ফেসবুক ও আইপি চ্যানেলের খবরে জানা যায়; ডালিমকে হোন্ডাচোর সন্দেহে গণপিটুনীতে মারা হয় টাকারজলা থানা এলাকায়। ওই সকল খবর থেকে জানা যায়; তার লাশ ত্রিপুরার জিবি হাসপাতালের মর্গে আছে। অপরদিকে জহির ও তার ভারতীয় ফুফাত ভাই নুর ইসলাম আগরতলা জেল হাজতে রয়েছে।
পরে মাদলা গ্রামের পক্ষ থেকে মুন্নাফ মিয়ার পুত্র রফিজ উদ্দিনকে পাসপোর্টে আগরতলায় পাঠানো হয় শিমুলের লাশ আনতে। সেখানে রফিজ উদ্দিন আগে থেকেই অবস্থান করা হাবিবুর রহমান শিমুলকে নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহকারী কমিশনার’র মাধ্যমে লাশটি গ্রহণ করে ১৩ জুন। ওই দিনই সন্ধায় লাশ নিয়ে আখাউড়া ইমিগ্রেশন ক্রস করে মাদলা গ্রামে ডালিমের লাশ নিয়ে আসে। ওই সময় ইমিগ্রেশনে মাদলা থেকে বেশকিছু গ্রামবাসী ডালিমের নিতে এসেছিলো। কিন্তু হাবিবুর রহমান শিমুল আখাউড়া ইমিগ্রেশন থেকেই আগরতলা ফিরে যায়। শিমুল কারো সংগেই কথা বলেননি।
সালমা আক্তার জানায়, আমি কসবা থানায় গিয়েছিলাম মামলা করতে। ও,সি আমাকে কোনো পাত্তাই দেননি। তাই গত ১৬ জুন ৩ জনকে আসামী করে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিজ্ঞ আদালতে মামলা দায়ের করেছি।আমি নিশ্চিত শিমুল আমার ছেলের সংগে তার স্ত্রীর প্রণয়ের প্রতিশোধ নিতে এই পরিকল্পিত হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।
বিজ্ঞ আদালত কসবা থানা অফিসার ইনচার্জকে গত ২৩ জুনের মধ্যে কসবা থানায় এ সংক্রান্ত কোনো মামলা রয়েছে কিনা প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন। দারোগা ইমরান হোসেন মাদলা গ্রামে যান গত ২২ জুন। সালমা বেগম আরো জানান; গ্রামে শত শত নারী পুরুষ দারোগা ইমরানকে জানিয়েছে পরকিয়ার জের ধরেই ডালিমকে পরিকল্পিতভাবে শিমুল, জহির ও হৃদয় ও তাদের ভারতীয় আত্মীয়রা হত্যা করেছে ।
কসবা থানার অফিসার ইনচার্জ আলমগীর ভূইয়া বলেন, ডালিম ভারতে হোন্ডা চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনীতে মারা গেছে বলে জেনেছি। যেহেতু ভারতে এ বিষয়ে মামলা রয়েছে তাই আমাদের থানায় এ মামলা হবে না। দারোগা ইমরান ও একই কথা বলেন সাংবাদিকদের।
এ ব্যাপারে জেলা বারের সিনিয়র এডভোকেট ফখরুল ইসলাম বলেন, ও.সি ও দারোগা ধান ভানতে শিবের গীত গেয়েছেন। বিজ্ঞ আদালত কসবা থানায় মামলা হয়েছে কিনা প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন। অথচ দারোগা প্রভাবিত হয়ে অবান্তর কথা-বার্তা লিখেছেন। একটি হত্যাকান্ডকে একটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা করেছেন যা দুঃখজনক। তিনি এই প্রতিবেদনের প্রতি অনাস্থা দেয়ার কথা জানান।
মাদলা গ্রামের রফিজ মিয়া, গৃহবধু রিনা আক্তার, আবু তাহের, রাসেল মিয়া, বাছির মিয়া সহ অসংখ্য মানুষ জানালেন হাবিবুর রহমান শিমুল ঠান্ডা মাথার কিলার। সে আগে থেকেই পাসপোর্টে ওই জায়গায় গিয়ে তার আত্মীয় স্বজন নিয়ে নাটক বানিয়ে স্ত্রীর পরকিয়ার প্রতিশোধ নিতে ডালিমকে হত্যা করেছে।
এ বিষয়ে শিমুলের স্ত্রী সাহিদাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান ডালিমকে ছোট ভাইয়ের মতো তিনি আদর করেছেন। গত দুমাস যাবত ডালিম আমাদের বাড়িতে আসে না। শিমুলের বাবা হানিফ মিয়া জানান ডালিম আমার ছেলেদের সংঙ্গে ব্যবসা করতো। গত দু মাস যাবত সে আমাদের বাড়িতে আসে না । শিমুল কোথায় আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন ১৫/২০ দিন যাবত ত্রিপুরায় আছে। সেখানে আমাদের আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে।