পল্লব রানা পারভেজ:
১৯২৩ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।সমাবর্তন বক্তা ছিলেন লর্ড লিটন। লর্ড লিটন সেদিন বলেছিলেন “জনসমক্ষে আমি এ-ই ঘোষণা দিচ্ছি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার খ্যাতি বৃদ্ধি করবে তা পূর্ববঙ্গ এমনকি ভারতের সীমারেখা ছাড়িয়ে যাবে। পূর্ববাংলার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একটি চমৎকার রাজকীয় ক্ষতিপূরণ(a splendid imperial compensation). লর্ড লিটনের কথা সত্যি হয়েছে, যখনই জাতীয় ঐক্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দরকার হয়েছে শাহবাগ জেগে থেকেছে, রাজু ভাস্কর্য প্রতিরোধ গড়েছে, মধুর ক্যান্টিন সাহস যুগিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা অনুভূতি, যে অনুভূতি দ্বারা ছাপান্না হাজার বর্গমাইল একত্রিত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদ জারি করা আছে। দেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম এবং সম্ভান্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়টি বরাবরই জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করেছে।
পৃথিবীর একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যে বিশ্ববিদ্যালয় একটি দেশের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান সফল প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাও এই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। তিনি ২৬ আগস্ট ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন, তিনি রোকেয়া হলে সংযুক্ত ছাত্রী ছিলেন। ১৯৬৭ সাল। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান। তিনি হয়তো গল্পের সেই রাখাল বালকের মতো উপলব্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অভিঘাতেই তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। হয়তো তাই পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হওয়ার পর থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুকে হয়রানি ও নিঃশেষ করে দেওয়ার সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।সে সময় সুধীমহলের সবাই জানতেন, গভর্নর মোনায়েম খানের প্রধান প্রতিপক্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ছিলেন তারই নিয়োজিত ড. ওসমান গণি। তিনিও ব্যক্তিগতভাবে প্রবল আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী ছিলেন। সেই প্রতিকূল সময়ে শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য যান। কিন্তু ড. ওসমান গণির আক্রোশের ভয়ে সে সময় সরকারের প্রবল প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা, কারাবন্দি ও বিচারাধীন শেখ মুজিবের মেয়েকে ভর্তি করতে অনেক বিভাগ আগ্রহী ছিল না। সে সময় শেখ হাসিনাকে বাংলা বিভাগে ভর্তি করার বিষয়ে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকা জেলে বন্দি ছিলেন। সেখানেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর আগ্রহে শেখ হাসিনা বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। তারপর তিনি নিয়মিত ক্লাস শুরু করলেন। শেখ হাসিনা লেখাপড়া ও শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে খুবই মনোযোগী ছিলেন। অত্যন্ত প্রাণোচ্ছল শেখ হাসিনা সহপাঠীদের সঙ্গেও ছিলেন খুব আন্তরিক। শিক্ষকদেরও তিনি অপরিসীম শ্রদ্ধা করতেন। সদালাপী ও সরলতায় তিনি অল্পসময়ে সবার আপন হয়ে ওঠেন। তার সম্পর্কে বেবী মওদুদ লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ও পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষ অনার্স ক্লাসে, সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ সালে। আমরা দুজন একই ক্লাসে পড়তাম। শেখ হাসিনা ঢাকায় স্কুল ও কলেজে লেখাপড়া করেছে, তাই তার বন্ধুর সংখ্যাও ছিল অনেক। সবার মাঝে সে ছিল আনন্দময় বন্ধু, সহমর্মী সাথি। তার এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিল বলে সে সবার প্রিয় ছিল। সবাই তাকে চিনত, জানত এবং তার সঙ্গে কথা বলে গল্প করে সময় কাটাতে দ্বিধাবোধ করত না।
আমি ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক হলেও তার সঙ্গে বা তার বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে বিন্দুমাত্র অস্বস্তি বোধ করতাম না। সবার সঙ্গেই তার ছিল অগাধ বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসা। খুব বড় মাপের মানুষের গড়ে ওঠার পেছনে এটা একটা বড় গুণ। তখন থেকেই দেখেছি তার মধ্যে বই পড়ার নেশা, রাজনীতিমনস্ক হয়ে ওঠা, মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে সাহায্য করা। অত্যন্ত বিনয়ী এবং শুদ্ধতম বাঙালি হয়ে ওঠার পেছনেও তাদের একটা পারিবারিক মূল্যবোধ আছে সত্য, তারপরও পিতা-মাতার প্রভাব শেখ হাসিনাকে একজন আদর্শ, মমতাময়ী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে’।
রোকেয়া হল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারকে লেখা এক পত্রে ( রোহ/পি/এফ/৬১/২০১৬ তাং ৩.৮.২০১৬) থেকে জানা যায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ১৯৬৭-৬৮ সেশনে বিএ (সম্মান) শ্রেণীতে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার ছিলো – হ-৭১৬, ক্লাস রোল – ৮৫২। সেই তৎকালীন সময়ে রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন মিসেস আখতার ইমাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক মোহম্মদ আবদুল হাই ( প্রয়াত)।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন সদস্য ছিলেন। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার অনেক স্মৃতি রয়েছে। এই ভিসি চত্বর, মধুর ক্যান্টিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজপথ জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সাহস জুগিয়েছিলো। জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে রাজপথ থেকে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সফল রাষ্ট্রনায়কে পরিণত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অপরিসীম ভূমিকা পালন করে৷ আমরা গর্ব করে বলতে পারি – জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সৃষ্টি, দেশরত্ন শেখ হাসিনা আমাদের অন্যতম প্রাপ্তি।লেখক – শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।