প্রশান্তি ডেক্স॥ শিশুদের ভবিষ্যতের সম্পদ হিসেবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি আমাদের দেশের প্রতিটি শিশুর অধিকার ও সুরক্ষা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সাথে কাজ করার জন্য আমার সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করতে চাই।’
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে সরকারি সফরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী ‘প্রত্যেক শিশুর জন্য শিশু সুরক্ষা: বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষায় সর্বোত্তম অনুশীলন’ শীর্ষক জাতীয় সিম্পোজিয়ামে সম্প্রচারিত এক ভিডিও বার্তায় একথা বলেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউনিসেফ নগরীর একটি হোটেলে জাতীয় সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রীর কন্যা এবং অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডারস বিষয়ক বাংলাদেশ জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ।
শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমান সরকার ইউনিসেফ ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় এসব শিশুদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের অবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সরকারের স্বল্প মেয়াদে শিশুদের সার্বিক উন্নয়নে কিছু অনন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু অধিকার বিষয়ক সনদ অনুসমর্থন ও স্বাক্ষরকারী প্রথম কয়েককটি দেশের অন্যতম। দেশকে ইউএনসিআরসি’র বিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার লক্ষ্যে আমরা শিশু আইন, ২০১৩ প্রণয়নসহ বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার বিশ্বাস করে আজকের শিশুরাই দেশের আগামী দিনের সম্পদ।
তিনি বলেন, তাদেরকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আমাদের শিক্ষা, পুষ্টি, চিকিৎসা, সুরক্ষা, অংশগ্রহণ, বিনোদন, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধির মতো মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ১৮ বছরের কম বয়সী যারা শিশু হিসাবে বিবেচিত হয় এবং তাদের মধ্যে ২০ মিলিয়নেরও বেশি বয়স ৫ বছরের কম।
বঙ্গবন্ধু প্রণীত সংবিধানে শিশুদের অধিকার রক্ষার জন্য বেশ কিছু ধারা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪, ১৫, ১৭, ১৮, ২৮, ২৯, ৩৪ এবং ৩৫ সহ দেশের সংবিধানের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদ সুরক্ষামূলক। এতে জীবনের মৌলিক অধিকার, স্বাধীনতা, আইনের অধীনে সমতা, আইনের সুরক্ষা, নির্যাতন থেকে মুক্তি এবং জোরপূর্বক শ্রম নিষিদ্ধ।
তিনি বলেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) বাংলাদেশের শিশুদের সুরক্ষা ও নিরাপদে রক্ষার জন্য শিশু আইন, ১৯৭৪ প্রণয়ন করেছিলেন।
তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী ৬৪টি জেলা শিশু কল্যাণ বোর্ড এবং ৪৯২টি উপজেলা শিশু কল্যাণ বোর্ড গঠিত হয়েছে এবং তারা তৃণমূল পর্যায়ে শিশু কল্যাণ ও সুরক্ষার জন্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কাজ করছে।
তিনি উল্লেখ করেন যে সম্প্রদায়-ভিত্তিক প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলো কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ এবং শিশুদের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরিতে কার্যকর পদ্ধতি হিসাবে বিবেচিত হয়। কাজেই, সরকার ইতোমধ্যে ৩০০টি সম্প্রদায় ভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটিকে জোরদার করেছে এবং সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাসেবকদের এতে জড়িত করার পথ প্রশস্ত করেছে। সাম্প্রতিককালে প্রতিটি সমাজে কিশোর অপরাধ উদ্বেগের বিষয় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ৭০ জন নিবেদিত প্রবেশন অফিসার এবং ১৮৯ জন শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী শিশুদের পরিবার এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক সংশোধনের জন্য কাজ করছেন।
এছাড়া, দুস্থ ও পথশিশুদের লালন-পালন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের জন্য সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচর্যার ব্যবস্থা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিশুদের চাহিদা পূরণে দারিদ্র্য অন্যতম প্রধান বাধা।
তিনি বলেন, আমাদের সরকার সকল যোগ্য নাগরিকের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল-এনএসএসএস তৈরি করেছে। এই ব্যবস্থা কার্যকরভাবে দারিদ্র্য, বৈষম্যকে মোকাবেলা করে এবং প্রতিরোধ করে এবং বৃহত্তর মানব উন্নয়ন, কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে।
তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় তার সরকার দেশের ১০.৭ মিলিয়ন মানুষের মাঝে বিভিন্ন ভাতা বিতরণ করছে।
তিনি বলেছেন, শিশুরাও এই কর্মসূচির সুবিধাভোগী। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছি। প্রায় ৯৮ শতাংশ স্কুলগামী শিশু নথিভুক্ত হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তি দ্বারা সমর্থিত হয়। প্রায় ২৩ মিলিয়ন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন উপবৃত্তি এবং বৃত্তি কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে।
তিনি বলেন, শিশুমৃত্যুর হার প্রতি ১০০০ জনে ২৩.৬৭ এবং মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি ১০০ হাজার জীবিত জন্মে ১৭৩-এ নেমে এসেছে।
তিনি বলেন, আমরা ১৮ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করেছি যা প্রধানত নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শিশু সুরক্ষার জন্য ভাতা’ নামে আরেকটি উপকারী কর্মসূচি চালু করতে পেরে তারা আনন্দিত, যা বিশেষ করে বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম এবং স্কুল থেকে ঝরেপড়া ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের উপকৃত করবে।
তিনি বলেন, আমাদের সরকার সমান নাগরিকত্ব, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান ইত্যাদির স্বীকৃতির জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করেছে। আমরা শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিসেবিলিটি প্রোটেকশন ট্রাস্ট-এনডিডি এবং প্রোটেকশন ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছি।
দেশের প্রতিবন্ধী তথ্য সিস্টেম-ডিআইএস একটি অসামান্য ডাটাবেস উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি ২৬ লাখ ৮৮,৭০১ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ডেটা সংরক্ষণ করে, যার মধ্যে অক্ষমতার মাত্রা এবং ধরন এবং সেই সঙ্গে ব্যক্তি, পারিবারিক এবং হস্তক্ষেপের জন্য মূল্যায়ন করা প্রয়োজনের অবস্থা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা প্রিয় কন্যা সায়মা ওয়াজেদের মহান নিষ্ঠা এবং চমৎকার প্রচেষ্টার প্রশংসা করি যিনি বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীতা ও শিশু বিকাশে অগ্রগতির জন্য অসাধারণ অবদান রেখে চলেছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার ২০১৬ সালে চাইল্ড হেল্পলাইন-সিএইচএল-১০৯৮ চালু করেছে। সিএইচএল-১০৯৮ এ পর্যন্ত ০.৮ মিলিয়নেরও বেশি শিশুর কণ্ঠস্বর শুনেছে এবং শিশু ও তাদের পরিবারকে পরিষেবা প্রদান করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁরা সব থানাকে শিশুবান্ধব করে তোলা, চাইল্ড হেল্প ডেস্ক স্থাপন, চাইল্ড অ্যাফেয়ার্স পুলিশ অফিসারদের মোতায়েন এবং শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী পৃথক তদন্ত বা তদন্তে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য কিছু ব্যবস্থা নিয়েছেন।
তিনি বলেন, একসময় বাংলাদেশে শিশুশ্রম একটি বড় সমস্যা ছিল। আমাদের দেশে শিশুশ্রম ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। তৈরি পোশাক খাত এখন শিশুশ্রম থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের অবস্থার উন্নতির জন্য অনেক কিছু করেছি। যদিও তাদের এখনও আরও বেশি কিছু করা দরকার। কারণ, তাঁরা চান যে বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু তাদের সমস্ত অধিকার ভোগ করে একজন যোগ্য নাগরিক হিসাবে বেড়ে উঠুক, বলেন প্রধানমন্ত্রী।