উদিসা ইসলাম॥ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ত্রিশ বছর বয়সী জীবন (ছদ্মনাম) ফেসবুকে আছেন গত সাত বছর ধরে। পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী মিলিয়ে বেশ সক্রিয় তিনি। গত প্রায় একবছর আগে তিনি এক নতুন বন্ধুর সঙ্গে আলাপ শুরু করেন। ফেসবুক প্রোফাইল দেখায় তাদের কয়েকজন মিউচুয়াল ফ্রেন্ড আছে। প্রবাসী ২২ বছর বয়সী রীনার (ছদ্মনাম) সঙ্গে প্রথমে হাই-হ্যালো পরে বন্ধুত্ব বাড়তে থাকে। তারা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হতে থাকেন। পরস্পরকে নানা বিষয়ে পরামর্শ দেন। রীনার প্রোফাইলে খুব বেশি ছবি নেই। সে জানায়, ছবি পাবলিক করতে তার ভালো লাগে না। নিজেদের ব্যক্তিগত আলাপে অফিসেরও নানা আলাপ করেন জীবন। একবছর পেরিয়ে জীবন তার এক সহকর্মীর মাধ্যমে জানতে পারেন রীনা আসলে তার অফিসেরই এক পুরুষ সহকর্মীর অ্যাকাউন্ট। হতভম্ব জীবন চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি ডিপ্রেশনে কাটিয়ে দেন তিন মাস। এরপর এক মানসিক চিকিৎসকের সহায়তায় তিনি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে শুরু করেন।
ফেসবুকে ছদ্মবেশ ধরে এ ধরনের বন্ধুত্বের কথা প্রায়ই শোনা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর ছবি ব্যবহার করে ‘প্রবাসী’, ‘সেলিব্রেটি’ নানা পরিচয় ব্যবহার করে এসব অ্যাকাউন্ট করা হয়। চট করে সন্দেহ যেন না হয় এমন করেই এসব অ্যাকাউন্ট সাজিয়ে রাখা হয়।
জীবনের মতো এরকম কতো মানুষ মানসিক প্রতারণার শিকার হচ্ছেন তার কোনও জরিপ নেই। কিন্তু মানসিক চিকিৎসকদের কাছে এ ধরনের অনেক সমস্যা নিয়ে প্রায়ই রোগীরা হাজির হন।
কেন প্রতারিত হতে হয়?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার না জানার কারণে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ ভালো ভালো ছবি, একটু গুছানো ছবি শেয়ার করে। সেটা দিয়ে সাদা চোখে কোনও সিদ্ধান্তে আসার সুযোগ নেই। আপনি যাকে একেবারেই চেনেন না, তার সঙ্গে কতটুকু শেয়ার করবেন সেটা শিখতে হয়। অন্যদের জীবনের নানা রঙিন ছবি দেখে যদি সেই ব্যক্তির লাইফস্টাইল বুঝতে চান তাহলে সেটি সবসময় ঠিক নাও হতে পারে। যদি কারও বাহ্যিক জীবন দেখে তার সঙ্গে বিশেষ কোনও আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে সম্পর্ক স্থাপন করেন তাহলে সেখানে সতর্কতার দরকার আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কতটুকু ব্যবহার করবেন বা করবেন না সেইটা আপনার বিবেচনা।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তাজুল ইসলাম মনে করেন, যেকোনও ভঙ্গুর অবস্থায় মানুষ যখন সম্পর্ক স্থাপন করে তখন তার যুক্তি কাজ করে না। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের প্রতারণার শিকার তারাই বেশি হয়, যারা মানসিকভাবে অস্থিতিশীল এবং বন্ধুহীন। তখন তারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কোনও যাচাই-বাছাই করে না এবং পরবর্তী সময়ে যখন ভুল বুঝতে পারে তখন আরও বেশি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।
ফেসবুক এমন একটা মাধ্যম বুঝবেন কীভাবে?
ফেসবুকে কার সঙ্গে কতটুকু যোগাযোগ করবেন এটার জন্য সবাই বিশেষজ্ঞ হবেন এমন নয়। কিন্তু কিছু সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছেন সাইবার জগৎ নিয়ে যারা কাজ করেন তারা। তানভীর হাসান জোহা বলেন, ফেসবুকে ব্যক্তির সক্রিয়তা কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা সম্ভব তার মধ্যে কোনও অস্বচ্ছতা আছে কিনা। আপনি একজনের সঙ্গে দিনের পর দিন কথা বলছেন টেক্সটের মাধ্যমে। সম্পর্ক যদি বেশি দিনের হয়, নিজের ব্যক্তিগত আলাপ করার আগে তাকে ভয়েস কল দিন। কণ্ঠ শুনলে মানুষ অনেককিছু বুঝতে পারে। আর সে যদি নারী না হয়ে পুরুষ হয় তাহলে আপনি তাকে কখনও ভয়েস কলে যুক্ত করতে পারবেন না। যদি না সে প্রকৃত অপরাধী হয় এবং কোনও নারীকে দিয়ে কল ধরায়। ফলে নিজের সতর্কতা নিশ্চিত করার কোনও বিকল্প নেই। তার পোস্টগুলো একটু ফলো করলেই তার দৈনন্দিন জীবন বুঝতে পারা যায়। কমন বন্ধু থাকলে তাদের সঙ্গেও কথা বলে দেখতে পারেন। ইনবক্সে নিজেদের ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে মানুষকে প্রতারিত করার অনেক কেস আমাদের কাছে আসে। সেগুলোর সবগুলোতে কাউকেই ন্যূনতম সতর্কতা অবলম্বন করতে দেখা যায়নি। অনলাইনের সোকল্ড পিএইচডিধারী স্কলারের চেয়ে পাশের বাসার সাধারণ ছেলেটাও অনেক নিরাপদ।