প্রশান্তি ডেক্স॥ রাগ নেই, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। রাগ হচ্ছে আমাদের আবেগের একটি অংশ। আমাদের প্রতিদিনের আনন্দ, কষ্ট, ঘৃণা, হাসি কান্নার মতো রাগও আবেগের বহিঃপ্রকাশ বা আচরণ। তাই রাগকে নিষ্ক্রিয় করা যাবে না। রাগকে নিষ্ক্রিয় করলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে। অনিয়ন্ত্রিত রাগকে নিয়ন্ত্রণ করাটাই হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য।
সাধারণত মানুষ কোনও কারণ ছাড়া ক্রুদ্ধ হয় না। কোনও না কোনও কারণে মানুষ রাগ করে। এর মধ্যে কোনও কারণ গ্রহণযোগ্য, আবার কোনওটি অগ্রহণযোগ্য বা অযৌক্তিক।
যেমন অবিচার, জুলুম, দুর্ব্যবহার, অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, কেউ মিথ্যা বললে, প্রতারণা করলে ও দারিদ্র্যের মতো সামাজিক অসঙ্গতিগুলো মানুষের যৌক্তিক রাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে ব্যর্থতা, অযৌক্তিক প্রত্যাশা, হিংসা-বিদ্বেষ ও অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ানোর মতো কিছু অভ্যাস অযৌক্তিক রাগের কারণ। অযৌক্তিক রাগগুলো নিষ্ক্রিয় করে ফেলাটাই ভালো।
কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন রাগ?
রাগ নিয়ন্ত্রণের মানে হচ্ছে রাগ থাকবে কিন্তু প্রকাশটা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকবে। মূলত কয়েকটি ধাপে বিশ্লেষণ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ শেখা যেতে পারে।
প্রথম ধাপ হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তির পরিবর্তন। এক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তি বা ইন্টেলেকচুয়াল ব্যাপারটা ভাবতে হবে। রাগ সম্পর্কে আপনার যে চিন্তা ভাবনা, ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গি সেটা আগে বুঝতে হবে। ধরে নিন আপনি শেষবার যে কারণে রাগ করেছিলেন সেটা যৌক্তিক রাগ ছিলো নাকি অযৌক্তিক রাগ ছিলো সেটা আগে খুঁজে বের করুন।
মানুষ রেগে গেলে বেশিরভাগ লক্ষণ প্রকাশ পায় তার আচরণে। অনেকে রেগে গেলে গালিগালাজ করেন, মারমুখী হয়ে ওঠেন কিংবা জিনিসপত্র ভেঙ্গে ফেলেন। আপনার আচরণগত প্রকাশটা কীভাবে করেন সেটা আগে খুঁজে বের করুন। এরপর সেখানে কী কী পরিবর্তন আনতে হবে সেটা নিয়ে ভাবুন।
যেহেতু রাগ প্রকাশের ধরন একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম, তাই স্বাভাবিকভাবেই নিয়ন্ত্রণের ধরনটাও একটু ভিন্ন ভিন্ন হবে। যারা খুব বেশি রাগী বা হুট করে রেগে গিয়ে চিল্লাচিল্লি করেন, গালিগালাজ করেন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্যকে আঘাত করার মতো ব্যাপার ঘটিয়ে ফেলেন, তাদের বড় কোনও ঝামেলা বা দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য তাৎক্ষণিক রাগ নিয়ন্ত্রণ করাটা খুবই জরুরি।
কিছু মানুষ আছে যারা সরাসরি রাগ প্রকাশ করেন না। তারা রাগকে মনের ভেতর পুষে রাখেন। এমনকি কেউ কেউ বুঝতেও পারে না যে মানুষটি রেগে আছে। তারা রাগকে মনের ভেতর রাখে এবং বিকল্পভাবে প্রকাশ করে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এ ধরনের রাগের বিকল্প প্রকাশ মারাত্মক ভয়ঙ্কর এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়। এ ধরনের রাগ নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। তাই সময় নিয়ে ধীরে ধীরে দীর্ঘমেয়াদি অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
রাগ নিয়ন্ত্রণের পুরো প্রক্রিয়া একটি চর্চার বিষয়। একদিনে বা অল্পদিনে এটা সম্ভব নয়। যার যত রাগ বেশি, তার তত বেশি সময় লাগবে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে দেখা গেছে, শর্ট টেম্পার হওয়ার কারণে যে সেনসেশন হয় সেটা সাধারণত ২.৫ সেকেন্ড স্থায়ী থাকে। তার মানে রাগ বেরিয়ে আসার আগে আমরা যে অসহ্যকর অনুভূতি অনুভব করি, সেটা স্থায়ী হয় ২.৫ সেকেন্ড। এই সময়ের মধ্যে রাগ প্রকাশ করে ফেললে তা বারবার ফিরে আসতে থাকে। এটা অনেকটা ইঞ্জিন স্টার্ট হওয়ার মতো। একবার রাগ বের হয়ে আসলে তা নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল। তখন রাগ আরও বাড়তে থাকে। কিন্তু যদি কোনও রকম রিয়্যাক্ট না করে ২.৫ সেকেন্ড কাটিয়ে দিতে পারেন, তাহলে সেই সেনসেশনটা নষ্ট হয়ে যায় এবং আবার নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়া সহজ হয়। অর্থাৎ এই ৩ সেকেন্ড নিয়ন্ত্রণ করাটাই মূল কথা।
১) রাগ না করার শপথ নিন
নিজের মনের সাথে প্রতিজ্ঞা করুন যে আপনার সাথে যাই ঘটুক না কেন, আপনি কোনোভাবে রেগে যাবেন না। রাগ করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে, আপনার মনকে শপথের কথা মনে করিয়ে দিন। আর মনে মনে বলুন, এখন আমার সাথে যেটাই হোক, সব পরে দেখবো। আমি এ মুহূর্তে কিছুই বলবো না। এভাবে ৩ সেকেন্ড পার করে দিন।
২) স্থান পরিবর্তন
বসে থাকলে দাঁড়িয়ে যান, প্রয়োজনে যে জায়গাটিতে রেগে যাওয়ার মতো কিছু ঘটেছে সেখান থেকে সরে যান। যার ওপর রাগ উঠেছে চুপচাপ সাধারন ভদ্রতা দেখিয়ে ৩ সেকেন্ড এর মধ্যে তার সামনে থেকে চলে আসুন। তার সাথে তখনই নয়, একটু পর স্বাভাবিক হয়ে কথা বলুন।
৩) গণনা করুন
সম্ভব হলে উল্টো গুনুন। ১০০ থেকে মনে মনে গুনতে গুনতে ১ পর্যন্ত আসুন। যদি এতো ধৈর্য্য না থাকে তাহলে অন্তত ১০ থেকে ১ পর্যন্ত গুনুন। এটি আপনার হার্টবিট কমিয়ে দেবে ও রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে।
৪) হেঁটে আসুন
রাগ সামলাতে না পরলে অল্প সময়ের জন্য হলেও ঘটনাস্থল ত্যাগ করুন এবং একটু হেঁটে আসুন। শারীরিক কসরত আপনার স্ট্রেস কমিয়ে ভাৎক্ষনিক আপনার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে।
৫) জোরে নিঃশ্বাস নিন
রেগে গেলে আমরা ঘন ঘন শ্বাস নিতে থাকি। এতে রাগ কিন্তু কমে না বরং বেড়ে যায়। ভাই গভীরভাবে শ্বাস গ্রহণ করুন, তারপর সেটি আস্তে আস্তে মুখ দিয়ে ছেড়ে দিন। এটি আপনার ভিতরে জমে থাকা রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে। এছাড়া গভীর শ্বাস তাৎক্ষণিকভাবে আপনার মস্তিষ্কে আক্সিজেনের প্রবাহ বাড়াবে। ফলে আপনি একটু স্থির বোধ করবেন।
৬) ঠান্ডা পানি পান করুন
খুব বেশি রাগ উঠে গেলে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি পান করুন। ঠান্ডা পানি শরীরে এক রকমের প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয় এবং মন শান্ত রাখতে সাহায্য করে।
৭) নির্দিষ্ট শব্দ বারবার বলুন নিজেকে
নিজেকে শান্ত করার মতো কোনও একটি শব্দ খুঁজে বের করুন। যেমন- রিল্যাক্স, টেক ইট ইজি, কাম ডাউন, নো-টেনশন, মাথা ঠাণ্ডা কিংবা গেট ওয়েল সুন এরকম যেকোনো বাক্য হতে পারে।
৮) মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে নিন
যখন বুঝবেন রেগে যাচ্ছেন, ৩ সেকেন্ডের মধ্যে চেষ্টা করবেন যে কারণে রাগ উঠছে সেই কারণ থেকে মনযোগ সরিয়ে নেওয়ার। তাৎক্ষনিকভাবে অন্য কোনও চিন্তা করুন। যেমন- আপনার পছন্দের কোনও ডায়লগ, কোনও ঘটনা, পছন্দের গান কিংবা মজার কোন ভিডিও দৃশ্য।