অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন: বিএনপি নেতারা কথা বলেই যাচ্ছেন। এত কথা অতীতে সরকারবিরোধী কোনো রাজনৈতিক দল বলতে পেরেছে কি না সন্দেহ। এখন বলতে পারছেন। সরকার পরিচালনা করছেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা। দেশের গণমাধ্যম অবাধ-স্বাধীনতা ভোগ করছে।
দেশে অনুমোদিত বেসরকারি টেলিভিশন ৪৫টি। এর মধ্যে পূর্ণ সম্প্রচারে ৩১টি, এফএম রেডিও ২৮টির মধ্যে সম্প্রচারে আছে ২২টি, দেশে নিবন্ধিত মোট পত্রিকা ৩ হাজার ২০১টি, নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে ২ হাজার ৯২০টি অনলাইন পত্রিকা। এখন পর্যন্ত অনেকগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পরিসংখ্যানটি ২০২১ সালের। স্বাভাবিকভাবে বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে বলেই ধরে নিচ্ছি। সবগুলো গণমাধ্যমই বিএনপির অতিকথন বা মিথ্যাচার গুরুত্বসহকারে সবিস্তার বর্ণনা করে। সাংবাদিকতার ভাষায় একটা কথা আছে `Bad news is good news’। সুতরাং গণমাধ্যম কর্মীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ক্ষমতাসীনদের সংযত আচরণ করতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে সাংগঠনিক শক্তির প্রদর্শনও জরুরি হয়ে পড়ে। কারণ আমাদের দেশে সংযম, ক্ষমা, মহানুভবতা অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বলতা মনে করা হয়।
টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন চিত্রের একটা সংলাপ এক সময় সকলের মুখে মুখে থাকত। কেউ যদি চাপাবাজি বেশি করত বা সত্যের অপলাপ করত তখন বন্ধু-বান্ধবরা টিপ্পনি কেটে বলত ‘কত কথা কয় রে!’ বিএনপি নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি দেখে সংলাপটি খুব করে মনে পড়ছে। সামরিক শাসনের গর্ভে জন্ম নেওয়া যে বিএনপি গণতন্ত্র হত্যা করছে তাদের গণতন্ত্রের জন্য আজ মায়াকান্না, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো জংলি আইন যারা করেছে, আইনের শাসনের জন্য তাদের উচ্চকণ্ঠ, হুন্ডাগুন্ডা দিয়ে যারা ভোট-ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে, অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তাদের আহাজারি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যে বিএনপির হাত ধরে বিভাজনের রাজনীতি শুরু সেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশের মানুষকে বিভাজনের জন্য আওয়ামী লীগকে দুষছেন। এমনকি ‘বর্তমান সময়ের চেয়ে পাকিস্তান ভালো ছিল’ বলে প্রকাশ্য সভায় উক্তি করে রক্তে কেনা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছে।
এ মন্তব্যর মধ্য দিয়ে বিএনপির চিরাচরিত বাংলাদেশ-বিরোধী অবস্থান ও স্বাধীনতা-বিরোধী অপরাজনীতির গোপন অভিসন্ধির আবারও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, প্রগতি ও দেশপ্রেমে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি কিংবা সংগঠন এ ধরনের মন্তব্য করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে তাদের এ ধরনের বক্তব্য প্রমাণ করে যে, মহান স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে তারা এখনও বাংলাদেশে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি প্রবর্তন করতে চায়।
বাংলাদেশের অগ্রগতি, সাফল্য, উন্নয়ন ও অর্জন যখন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত তখন বিএনপি নেতারা পাকিস্তান আমলের প্রশংসা করেন! যেখানে খোদ পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ও গণমাধ্যমে বাংলাদেশের অগ্রসরমান অর্থনীতির প্রশংসা করা হচ্ছে, তখন বিএনপি নেতারা নির্লজ্জভাবে পাকিস্তানের দালালি করছে। যখন তাদের বুদ্ধিজীবীরা বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার মতো একজন সুদক্ষ নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে তখন বিএনপি মহাসচিব পাকিস্তান আমলে ফিরতে চাচ্ছেন। পাঠকের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে- পাকিস্তানের ক্যাপিটাল টিভির এক টকশোর কথা। যখন টকশোতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দেশকে সুইডেন বানানোর প্রতিশ্রুতির বিষয়টি আলোচনায় আসে, তখন সে-বিষয়ে কটাক্ষ করে এক বক্তা বলেছিলেন, ‘খোদার দোহাই- আমাদের বাংলাদেশ বানিয়ে দাও, সুইডেন হবার দরকার নেই।’
স্বাধীন বাংলাদেশে যারা রাজনৈতিকভাবে এবং পারিবারিকভাবে পাকিস্তানি দর্শনের রাজনীতিকে লালন করে, তারা স্বাধীনতার ৫১ বছর পর এখনও ‘পেয়ারে পাকিস্তান’ মন্ত্র জপছে। বিএনপি মহাসচিবের এহেন বক্তব্য শুধু দেশদ্রোহিতার শামিল নয়; বরং ৩০ লাখ শহিদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ঠাকুরগাঁও জেলার কুখ্যাত রাজাকার মির্জা রুহুল আমীন ওরফে চোখা মিয়ার সন্তান। ১৯৭১ সালে চোখা মিয়া ঠাকুরগাঁও জেলার শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় নাম ছিল। সুতরাং রাজাকারী রক্তের উত্তরাধিকারী মির্জা ফখরুলের পাকিস্তানের প্রতি মায়া-মহব্বত থাকবে- এটাই স্বাভাবিক।
যুগ যুগ ধরে বিভাজনের রাজনীতির শিকার বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ধাপে ধাপে আন্দোলন-সংগ্রাম করে ৩০ লাখ শহিদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে একটা স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র আমাদের উপহার দিয়েছেন। বাঙালির এই ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে। সাম্প্রদায়িক ও অবৈজ্ঞানিক দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দুটি পৃথক ভূখণ্ড নিয়ে কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠিত হয়। পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী ধর্ম-ভাষা-সম্প্রদায়ভিত্তিক বিভাজন তৈরি করে শোষণের ধারা অব্যাহত রাখে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের দার্শনিক ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার আলোকে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ গড়ার শপথ নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জেনারেল জিয়া জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে। সামরিক ফরমানবলে সংবিধানকে যথেচ্ছভাবে সংশোধন করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চরিত্র পাল্টে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নির্বাসিত করে স্বাধীনতা-বিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলোকে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে পুনর্বাসিত করা হয়। জেনারেল এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়া এই ধারা অব্যাহত রাখেন।
স্বাধীনতার ৫১ বছর পরেও বিএনপি পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি থেকে বের হতে পারেনি। ১৯৭১ সালে লড়াইয়ের মাঠে মীমাংসিত বিষয়কে সামনে এনে নিত্যনতুন বিতর্ক সৃষ্টি বিএনপি নেতা-কর্মীদের জন্মগত অভ্যাস। বিএনপির রাজনীতিই ছিল দ্বি-জাতিতত্ত্বের রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর জগদ্বিখ্যাত ভাষণ- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এর মাধ্যমে বাঙালির যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য রচিত হয়েছিল, সেই ঐক্য বিনষ্ট করেছে সেনা ছাউনির উচ্ছিষ্ট ভোগ করা সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক গোষ্ঠী। দীর্ঘ বছর পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় পুনঃপ্রত্যাবর্তনের ফলে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধারার অবসান হয়। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার সরকার জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। সেকুলার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিএনপি নেতাদের সহ্য হবে না- এটাই স্বাভাবিক।
বিএনপির আরেক নেতা রুহুল কবির রিজভী, যাকে মানুষ রেসিডেন্সিয়াল নেতা বলে। তিনি প্রতিদিনই অফিস কক্ষে বসে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কল্পিত মিথ্যাচার ও কুৎসা উদগীরন করে থাকেন। তার বক্তব্যেও পাকিস্তান প্রীতির উলঙ্গ বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই। ‘পাকিস্তান আমলে গুম হয়নি’ বলে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের চেতনায় আঘাত করেছেন। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি বাংলাদেশ। রাজাকার-আলবদরদের সহযোগিতায় হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, গুম করা হয়েছে। সন্তানহারা পিতা, স্বামীহারা স্ত্রী, ভাইহারা বোনরা আজও স্বজন হারানোর ব্যথা বুকে নিয়ে দিনাতিপাত করেছে। বিএনপি নেতা রিজভী কৌশলে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের অপরাধকে আড়াল করতে চেয়েছেন। তার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে পাকিস্তানকে খুশি করার চেষ্টা করেছেন। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তানি জেনারেল জানজুয়ার মৃত্যু দিবসে শোক বার্তা পাঠিয়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেছেন।
বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরে এসেছে। উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারির সময় বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত, তখন শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিরূপ পরিস্থিতিকে সামাল দিয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি সবল রয়েছে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল।
উন্নয়নের এই মহাসড়কে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়া, গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশ পরিচালনার পথ কোনোভাবেই মসৃণ ছিল না। বিএনপি-জামাতসহ স্বাধীনতা-বিরোধী সকল অপশক্তি এক হয়ে প্রগতির চাকাকে উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সন্ত্রাস ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পাকিস্তানি সেবাদাস ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের চেষ্টা হয়েছে। শায়খ আবদুর রহমান, মুফতি হান্নান ও বাংলাভাইয়ের মতো কুখ্যাত জঙ্গি নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছিল। বিএনপির শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সন্ত্রাসীদের ট্রেনিং ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্রের জোগান দিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ পক্ষের মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্টের নারকীয় গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। এটা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট- সব ষড়যন্ত্রের পিছনে রয়েছে পাকিস্তানি সেবাদাস বিএনপি নেতৃত্ব। বঙ্গবন্ধু-কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্ব, প্রজ্ঞা, সততা ও সাহসের কাছে ষড়যন্ত্রকারীরা পরাস্ত হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা ও ষড়যন্ত্রকারীরা যতই অপচেষ্টা চালাক না কেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না।
লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
সৌজন্যেঃ উত্তরণ