প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স॥ দুর্যোগ মানেই মানবিক বিপর্যয়। দুর্যোগকালে নারী-শিশু, প্রতিবন্ধী ও প্রবীণরাই সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েন। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতুবৈচিত্র্যের এই দেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, শৈত্যপ্রবাহসহ নানা দুর্যোগের সঙ্গে পরিচিত মানুষ।
গত (১৩ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার) দুর্যোগ প্রশমন দিবস। দিবসটি উপলক্ষে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড আর্লি অ্যাকশন ফর অল’। দুর্যোগের কারণে প্রতিবছর সারা বিশ্বে জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করার কোনও উপায় এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। এ কারণে দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস। প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে দুর্যোগ মোকাবিলায় সবাইকে একসঙ্গে ও সমন্বিতভাবে কাজ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশ এখন দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে।’
তিনি আশা প্রকাশ করেন, জাতির অগ্রযাত্রার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষায় বাস্তবরূপ দিতে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত ও শোষণমুক্ত দেশ গড়তে সংশ্লিষ্ট সবাই নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাবে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় পূর্ব সতর্কীকরণ ও ঝুঁকি হ্রাসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রধান ভূমিকা রাখে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় জনগণের জন্য দুর্যোগপূর্ব পূর্বাভাস ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কৌশল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’ তিনি জানান, স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপকূলীয় বনায়নের মাধ্যমে সর্বপ্রথম দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রমের সূচনা করেছিলেন। ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র এবং মাটির কিল্লা নির্মাণের কাজও তখন থেকে শুরু হয়। সে সময়ে জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া ও ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সতর্ক সংকেত প্রচারের জন্য ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচিকে সরকারের অন্যতম একটি কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল, যা দুর্যোগ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আজও কার্যকর অবদান রাখছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, ‘‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ‘আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস-২০২২’ পালিত হচ্ছে জেনে আমি আনন্দিত।’ ’দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড আর্লি অ্যাকশন ফর অল’-কে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ ও সময়োপযোগী মনে করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বর্তমানে আকস্মিক বন্যা মোকাবিলা ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে রিমোট সেনসিং, জিআইএস, রাডার, স্যাটেলাইট তথ্যচিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে বন্যা আসার ৩ থেকে ৫ দিন আগেই বন্যা পূর্বাভাস ও বন্যার স্থায়িত্ব সম্পর্কে সতর্ক বার্তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন উন্নত গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে ঘূর্ণিঝড় ও বজ্রপাতের পূর্বাভাস ও সতর্কতা বার্তা প্রদান সম্ভব হচ্ছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সরকার এ পর্যন্ত উপকূলে প্রায় ৪ হাজার ২০০টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, বন্যাপ্রবণ এলাকায় ৪২৩টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র এবং সারা দেশে ৫৫০টি মুজিব কিল্লা নির্মাণ করেছে। আমরা ‘মুজিব কিল্লা’কে সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন করে মানব ও প্রাণিসম্পদের জন্য নিরাপদ ও টেকসই আশ্রয়স্থল করেছি।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, যেকোনও বিষয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি থাকলে ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে সীমিত রাখা সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা কারণে বিশ্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য আগাম সতর্ক ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে জনগণের সুরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা নিলে উন্নয়নও টেকসই হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, যেহেতু দুর্যোগ আগাম বার্তা দিয়ে আসে না, সে কারণে সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় সবসময় সতর্ক অবস্থানে থাকার কোনও বিকল্প নেই। বাংলাদেশকে দুর্যোগ সহনশীল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার প্রণীত আগামী ১০০ বছরের জন্য গৃহীত সরকারের ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-তে উপকূল ও বন্যাপ্রবণ কয়েকটি এলাকাকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং প্রতিটি হটস্পটের বাজেট ধরা হয়েছে ৩৭ বিলিয়ন ডলার। দুর্যোগ প্রশমনে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠিত ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৫০ বছরে পদার্পণ উদযাপন করেছে বাংলাদেশ। আগের যেকোনও সময়ের তুলনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনবল, উদ্ধার সামগ্রী এবং দক্ষতা বেড়েছে। বেড়েছে দুর্যোগের কবল থেকে মানব ও সম্পদ রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের কমিটমেন্ট। যে কারণে দুর্যোগ মোকাবিলায় সংশ্লিষ্টদের আহত ও নিহত হওয়ার ঘটনাও কম ঘটছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, নদীভাঙনের শিকার ৯ হাজার ৪৪৫টি পরিবারকে দুই শতাংশ জায়গাসহ পাকাঘর করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, যার কাজও শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে এই গৃহহীনদের তালিকা করা হয়েছে। নদীভাঙন রোধে টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য ডেল্টা প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। ডেল্টা প্ল্যানের মধ্যে একটি হটস্পট হচ্ছে নদী ব্যবস্থাপনা। সেই ব্যবস্থাপনার আওতায় রয়েছে—নদীতে টেকসই বাঁধ দেওয়া, নদী খনন করে নাব্য সৃষ্টি করা। ২০৩১ সালের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৩৭ বিলিয়ন ডলার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার প্রতিনিধিরা কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ ও কক্সবাজারের নদীগুলো শাসন করে বন্যা ব্যবস্থাপনার কাজ শুরু করেছে। সব দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সফলতা অর্জন করেছে। সরকার বিল্ডিং কোড করেছে। এই কোড মেনে আগামীতে বাড়িঘর নির্মাণ করলে তা ভূমিকম্প সহনীয় হবে। ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় মাত্রায় বিল্ডিং কোড তৈরি করা হয়েছে। পুরনো ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনীয় করতে জাইকার সঙ্গে একটি সমঝোতা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ৫০ বছর মেয়াদি একটা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। ভূমিকম্প সহনীয় না হলে সংস্কারের মাধ্যমে তা ভূমিকম্প সহনীয় করা হবে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ৪৫৬টি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন করা হয়েছে। এটাকে ৫৫০টি উন্নীত করতে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সিভিল ডিফেন্সের জনবলকে আরও দক্ষ করে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধু ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি নামে একটি প্রতিষ্ঠান করার জন্য মুন্সীগঞ্জে ১০০ একর জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেটির কাজ শুরু হয়েছে বলেও জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশকে দুর্যোগ সহনশীল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি জানান, ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-তে উপকূল ও বন্যাপ্রবণ কয়েকটি এলাকাকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি না থাকলে শুধু জানমালের ক্ষতি নয়, দেশের সার্বিক উন্নয়নই ব্যাহত হতে পারে। তাই এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ হওয়ায় প্রস্তুতির বিষয়টি আমাদের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ। উপকূল ও বন্যাপ্রবণ এলাকায় দুর্যোগ সহনশীল টেকসই অবকাঠামো গড়ে তোলা জরুরি।’ দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা নিলে টেকসই হবে উন্নয়ন বলে মনে করেন তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর সূত্র জানায়, দেশে বজ্রপাত এখন বড় দুর্যোগ। গত ছয় মাসে বজ্রপাতে ২৮২ জন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন ৭৮ জন। বজ্রপাতে মৃত্যু হওয়া ২৮২ জনের ২৭৮ জনই প্রান্তিক কৃষক। তারা জমিতে কাজ করার সময় মারা গেছেন। কৃষকদের নিরাপত্তা না দিতে পারলে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।