প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স॥ সালটা ১৯৯০। ভারতে তখন ক্ষমতায় ভি পি সিংয়ের নেতৃত্বে জনতা দলের জোট সরকার। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে হরিয়ানার মেহামে উপনির্বাচন করতে হলো। কারণ, দেবীলাল দেশের উপ-প্রধানমন্ত্রী হয়ে দিল্লিতে চলে গেছেন। তার জায়গায় ছেলে ওমপ্রকাশ চৌটালা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু তাকে কোনও একটা কেন্দ্র থেকে জিতে আসতে হবে। চৌটালা দাঁড়ালেন মেহামের প্রার্থী হয়ে।
মেহামে ২৮ ফেব্রুয়ারির সেই উপনির্বাচন ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়গুলোর একটি বললেও বোধহয় পুরোটা বলা হয় না।
দিল্লির পার্লামেন্ট ভবন থেকে মাত্র সোয়াশ’ কিলোমিটার দূরে হরিয়ানার ওই জনপদে সেই ভোটগ্রহণের দিন যেভাবে ঢালাও বুথ দখল হয়েছিল ও অবাধে ছাপ্পা ভোট পড়েছিল, বোমাবাজি, খুনখারাপি থেকে শুরু করে পুলিশের গুলি পর্যন্ত চলেছিল—তা মনে করলে মেহামের সাধারণ মানুষ আজও শিউরে ওঠেন।
ভারতের প্রবীণ সাংবাদিকরা বলেন, মেহাম আর ইংরেজি ভাষার ‘মেইহেম’ (চরম সহিংসতা আর বিশৃঙ্খলা) সেদিন সমার্থক হয়ে উঠেছিল।
বিকালের আগেই দেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরভিএস পেরি শাস্ত্রী জানিয়ে দিলেন, ভোটের নামে মেহামে যা হচ্ছে সেটা প্রহসন। ততক্ষণে ভোট রিগিংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে অন্তত ১৩ জন চৌটালার পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। গুন্ডারা হাজার হাজার ব্যালটে ছাপ্পা মেরে বাক্স ভরিয়ে দিয়েছে।
সব দলই মেহামের নির্বাচন বাতিল করার দাবি জানালো– এমনকি দিল্লিতে চৌটালার পার্টি জনতা দলও বাদ গেলো না। প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং আর তার ডেপুটি দেবীলালের মধ্যে মতান্তরের শুরুও সেটা থেকে, যদিও তা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
এই অধ্যায়ের ইতিবাচক দিক ছিল একটাই– ভারতীয় গণতন্ত্রে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম খুব দরকার, এই ভাবনাটা ট্রিগার করেছিল মেহামের সেই কুখ্যাত উপনির্বাচন।
‘রিগিংকে কঠিন করে তুলেছে’
ভারতের সাবেক নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশি বলছিলেন, ‘ইভিএম নিয়ে দেশে প্রথম পাইলটিং শুরু হয় ১৯৮২ সালে, কেরালাতে। কিন্তু তারপর বিষয়টা নিয়ে কেউই খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি, কাজকর্মও খুব এগোয়নি। কিন্তু ৯০’র পর নির্বাচন কমিশন আবার নড়েচড়ে বসে এবং ১৯৯৮ থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপকভাবে ইভিএমের ব্যবহার শুরু হয়ে যায়।’
তিনি সেই সঙ্গে আরও বলেন, ‘ইভিএম দিয়ে ভোট করানো হলেও সেটা যে আইনশৃঙ্খলার সমস্যার প্রতিকার করতে পারবে না, সেটা কিন্তু বুঝতে হবে। মেহামে প্রশাসন ও পুলিশের মদতে ব্যাপক গুন্ডাগিরি হয়েছিল, যেটা ইভিএম দিয়ে ভোট করালেও ওখানে হতোই।’
কিন্তু তাহলে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ভারতে কীভাবে এত সফল হলো?
এস ওয়াই কুরেশির মতে, এর কতগুলো বিশেষ কারণ আছে। প্রথম কারণ হলো, ইভিএমে এমনভাবে প্রোগ্রাম করা থাকে যে তাতে মিনিটে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি ভোট দেওয়া যায় না। ধরা যাক, সেটা মিনিটে পাঁচটা। এখন, কোনও রাজনৈতিক দলের গুন্ডারা যদি একটা বুথে সব ছাপ্পা ভোট মারতে যায় আর সেই বুথে মোট ১৫শ’ ভোট থাকে, তাহলে সেই বুথে সব জাল ভোট দিতে হলে তাদের পুরো পাঁচ ঘণ্টা ধরে সেটা দখল করে রাখতে হবে—যা প্রায় অসম্ভব।
অথচ সেই একই বুথে যদি কাগজের ব্যালট দিয়ে ভোট করানো হয়, তাহলে মাত্র পাঁচ-দশ মিনিটের ভেতর একধারসে তাতে ছাপ্পা মেরে গুন্ডারা বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। ফলে ভারতে ইভিএম পরোক্ষভাবে ভোট জালিয়াতিকে অনেক কঠিন করে তুলেছে।
দ্বিতীয়ত, ইভিএমের সুবাদে ভোট গণনার সময় নাটকীয়ভাবে কমে এসেছে। ১৯৯০-র দশকেও (যখন পুরোপুরি কাগজের ব্যালট ছিল) ভারতের সাধারণ নির্বাচনগুলোতে পুরো ফলাফল আসতে তিন-চারদিন লেগে যেতো। আর ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচন থেকে ভোট-গণনার দিন দুপুর বা বিকেলের মধ্যেই ফলাফল পরিষ্কার হয়ে যায়—যার প্রধান কারণ, ইভিএমে ভোট গুনতে প্রায় কোনও সময়ই লাগে না।
তা ছাড়া, ইভিএমে কোনও ভোট বাতিল হয় না বলে গণনার সময় বিতর্কও কম হয়। পেপার ব্যালটে ভোটার ঠিক জায়গায় ছাপ দিয়েছেন কিনা, তার দেওয়া সিল বর্ডারের বাইরে চলে গেছে কিনা—এটা নিয়েও গণনার সময় বিভিন্ন দলের এজেন্টদের মধ্যে প্রচুর তর্কাতর্কি ও বাগবিতণ্ডা হয়। কিন্তু ইভিএমে সেটা নেই বলে ভোট গণনার পুরো প্রক্রিয়াটাই অনেক মসৃণ হয়ে গেছে বলে এস ওয়াই কুরেশির অভিমত।
‘নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করেছে’
আমেরিকাভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ব্রুকিংস’ ভারতীয় গণতন্ত্রে ইভিএম কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে, তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছে। ২০১৭-তে ব্রুকিংস-এর গবেষক শামিকা রাভি, শিশির দেবনাথ ও মুদিত কাপুর তাদের প্রতিবেদনে পরিষ্কার বলেছিলেন—
ক. ইভিএম চালু করার পর ভারতে নির্বাচনি জালিয়াতি অনেকটাই কমেছে
খ. সমাজের দুর্বল, ভালনারেবল ও পিছিয়ে থাকা শ্রেণির ক্ষমতায়ন হয়েছে, কারণ তারা নিজের ভোট নিজে দিতে পারছেন।
গ. দেশের সার্বিক নির্বাচনি পরিবেশ অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে।
ওই রিপোর্টের অন্যতম প্রণেতা শামিকা রাভি এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘আসলে ভারতের মতো একটা বিশাল দেশে, যেখানে ৯০ কোটিরও বেশি নথিভুক্ত ভোটার এবং একটি জটিল বহুদলীয় রাজনৈতিক সিস্টেম আছে, সেখানে আজকের যুগে নির্বাচনের জন্য ইভিএম ছাড়া কোনও গতি নেই বলেই আমরা মনে করি।’
বস্তুত ভারতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অত্যন্ত তিক্ত বিরোধ থাকা সত্ত্বেও সে দেশের নির্বাচনগুলো যে সেরকম প্রশ্নবিদ্ধ নয়। পরাজিত দল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্বাচনের রায় মাথা পেতে নেয়—তার পেছনে ইভিএমের একটা খুব বড় ভূমিকা আছে বলেই মনে করেন শামিকা রাভি।
সন্দেহ কি একেবারেই নেই?
কিন্তু এটাও তো ঠিক, যে ভারতে বিভিন্ন দল বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেছে ইভিএম ‘ম্যানিপুলেট’ করা যায়—অর্থাৎ এই যন্ত্রটির ফলাফলেও কারচুপি করা যায়?
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশি জবাবে বলছেন, ‘ভারতের সব বড় দল—বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম সবাই একটা পর্যায়ে ইভিএমের বিরোধিতা করেছে। আবার ইভিএমে হওয়া ভোটে বিপুলভাবে জিতে তারাই আবার সেই আপত্তি হজম করে নিয়েছে, এমনও প্রচুর দৃষ্টান্ত আছে। কাজেই ভারতে যারা ইভিএম নিয়ে আপত্তি করেন তারা নিজেও যে খুব সিরিয়াসলি সেটা করেন তা কিন্তু নয়– হয়তো নিছক রাজনৈতিক কারণে কখনও কখনও তারা ওটা বলেন।’
২০১৩ সাল থেকে ভারতে ইভিএমের সঙ্গে ভিভিপ্যাট বা পেপার ট্রেইল যোগ করার পদ্ধতিও যুক্ত হয়েছে। একজন ভোটার যন্ত্রে যেখানে ভোট দিয়েছেন সেটা সত্যিই সেখানে পড়লো কিনা তাই ভিভিপ্যাটের কাগজ দেখে মিলিয়ে নেওয়া যায়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এখন দেশের প্রতি কেন্দ্রে অন্তত পাঁচটি বুথের ভিভিপ্যাটের সঙ্গে ইভিএমের ফলাফল মিলিয়ে দেখতে হয়—তবে আজ পর্যন্ত তাতে একটি ক্ষেত্রেও কোনও ‘মিসম্যাচ’ পাওয়া যায়নি।
কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ইভিএম নিয়ে ভারতে যাদের মনে ছিটেফোঁটাও সন্দেহ আছে সেটা দূর করার জন্য মাত্র পাঁচটি বুথ নয়—সব বুথেরই ভিভিপ্যাট বা পেপার ট্রেইল মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। এরা বলছেন, সেক্ষেত্রে হয়তো ভোট গণনায় এক-আধবেলা বাড়তি সময় লাগবে, কিন্তু তাতে ক্ষতি কী?
বস্তুত মাত্র সিকি শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম যে ভারতীয় গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে তা নিয়ে আর কোনও সংশয় নেই। নির্বাচনি প্রক্রিয়ার বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলের নেতারা সবাই জানেন, ভারতের পক্ষে এখন পেপার ব্যালটে ফিরে যাওয়া একরকম অসম্ভব।