হারিস চৌধুরী: শূন্য থেকে শত কোটির মালিক; জঙ্গিবাদ ও রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের মাস্টারমাইন্ড

বাআ॥ ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ছিল হারিস চৌধুরী। এমনকি তারেক রহমানের হাওয়া ভবন সিন্ডিকেটেরও প্রভাবশালী ব্যক্তি সে। ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড মেরে হত্যাচেষ্টার প্লট তৈরি করেছে যারা, তাদের অন্যতম একজন। এমনকি সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ কিবরিয়াকে হত্যার পর তার ভাতিজাকেও অপহরণ করেছিল এই ব্যক্তি। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কার্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি সরকারি কাজে মোটা অঙ্কের কমিশন নিতো সে। তাকে টাকা না দিলে কোনো কাজই বের হতো না প্রধানমন্ত্রীর দফতর এবং বেশকিছু মন্ত্রণালয় থেকে।

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর আত্মগোপনে চরে যায় এই শীর্ষ দুর্নীতিবাজ এবং সন্ত্রাসীদের গডফাদার। তখন যুগান্তর পত্রিকায় তথ্য-প্রমাণসহ হারিস চৌধুরীর সীমাহীন সন্ত্রাস, দুর্নীতি, লুটপাট এবং অপকর্মের তথ্য প্রকাশ হয়।

সিলেটের স্থানীয়রা জানান, শাহ কিবরিয়াকে হত্যার পর সেই বিচারকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল হারিস চৌধুরী। সিলেটের কানাইঘাটের বাড়ি তার। ২০০১ সালের আগ পর্যন্ত বিজয়নগরের একটি ভাড়া বাসায় থাকতো সে। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার জন্য সবার কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নিতে হয়েছিল তাকে। তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই বদরে যায় তার ভাগ্য। মাত্র পাঁচ বছরে শত শত কোটি কোটি টাকার মালিক হয় সে। দেশজুড়ে গড়ে তোলে চাঁদাবাজির একচ্ছত্র সাম্রাজ্য।

খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই হারিস চৌধুরী এবং মোসাদ্দেক আলী ফালুকে রাজনৈতিক সচিব নিয়োগ দেন। এরপর তারেক রহমানকে সঙ্গে করে ফালুকে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে সরিয়ে দেয় হারিস। এর পরের দুই বছরের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়া ও লন্ডনে একাধিক বাড়ি এবং ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক হয় হারিস। ঢাকার গুলশানে একটি বাড়ি ও পাঁচটি প্লট হয় তার। ব্যবহার করতেন চার কোটি টাকা দামের ইনফিনিটি গাড়ি। তার ভাই সেলিম চৌধুরী শাহজাহানপুরে একটি ছোট স্টিলের আরমারির দোকান চালাতো। হারিসের সৌজন্য সেও হয়ে যায় কোটি কোটি টাকার মালিক। ভাই সেলিম ও স্ত্রীর ছোট ভাই মাসুমও অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকায় নিজস্ব ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলে, হয় একাধিক বাড়ি ও গাড়ির মালিক।

কিবরিয়া হত্যা:

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া জানান, কিবরিয়াকে হত্যাকাণ্ডের পর একদিন রাতে হারিস চৌধুরী মরহুম কিবরিয়ার ব্যাংক কর্মকর্তা ভাতিজাকে ফোন দেয়। তাকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে নিয়ে যায়। তখন খালেদা জিয়া তাকে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশবিদেশের গণমাধ্যমে বক্তব্য না দিতে বলেন। ২০০১ সালে হবিগঞ্জের চার আসনেই আওয়ামী রীগ জয়ী হয়, সেখানে কিবরিয়ার প্রভাব ছিল। একারণে ২০০৫ সালে কিবরিয়াকে হারিস চৌধুরীর পরিকল্পনামতো হত্যা করা হয় বলে পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন।

পিএসসিতে নামের তালিকা:

সরকারি চাকরির জন্য পিএসসির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নষ্ট করে দিয়েছিল এই হারিস চৌধুরী। পরীক্ষায় দিয়ে ভালো করলেও অনেকের চাকরি হতো না। কারণ, হারিস চৌধুরীর তালিকা অনুসারে চাকরি দিতে বাধ্য করা হতো। এই নিয়োগ বাণিজ্য থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করে হারিস চৌধুরী। এমনকি হারিসের হাত ধরে তারেক রহমানও ছাত্রদল নেতাদের তালিকা দিয়ে পরপর তিনটি বিসিএসে নিয়োগকে কলঙ্কিত করেছিল। বগুড়া থেকেই একেকবার ২০-২৫ জন করে এএসপি পদে নিয়োগ পাওয়ায় সারা দেশে বিসিএস পরীক্ষাও প্রশ্নের মুথে পড়ে!

সরকারি ফাইল থেকে দুর্নীতির দরজা: 

রাষ্ট্রীয় নিয়ম অনুসারে, সরকারি ফাইল দেখার অনুমতি না থাকলেও হারিস চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সামনেই সব সরকারি গোপন ফাইল পড়ে দেখতো। এবিষয়ে সরকারে সচিব নুরুল ইসলাম বলেন, হারিস চৌধুরীর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে বলা হলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নিতেন না। ফলে এসব গোপন ফাইল দেখে হাজার হাজার কোটি টাকার সরকারি কাজের আগাম খোঁজ পেতো হারিস। তারপর সেসব কাজের জন্য দেনদরবার করে শত শত কোটি টাকা উপার্জন করে। এসব কিছুই তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে করতো হারিস। হারিসের সব অপকর্মে খালেদা জিয়ারও সম্মতি ছিল।

ঘুষ-চাঁদাবাজি-দুর্নীতি: 

হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হওয়ায় নিয়মিত তারেক রহমানের কাছে সব কাজের বাট্টা পৌঁছে দিত হারিস চৌধুরী। সরকারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, পদোন্নতি, পোস্টিং প্রভৃতি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা আয় করে হারিস। যোগ্যতা না থাকলেও বিদ্যুৎ বোর্ডে নিজের লোককে বসিয়ে দিয়ে শত কোটি টাকার টেন্ডার লুটপাট করে সে। বন বিভাগকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করে হারিস চৌধুরী। প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ থেকে এক লাখ করে টাকা দিতে হতো তাকে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বধিরদের জন্য বরাদ্দ কোটি টাকা লোপাট করে সে। শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ সেক্টরে সীমাহীন দুর্নীতির জন্য দেশে বিদ্যুৎ সংকট দেখা হয় তখন। এমনকি হারিসের দুর্নীতির দাপটে বিদেশিরাও বিনাসুদে যেসব প্রকল্পে ঋণ দিতো, তারাও তা বন্ধ করে দয়, এরমধ্যে পিআরএসসি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক এবং এডিবির ৫০ মিলিয়ন ডলার অনুদান ফেরত নেওয়ার ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য।

সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা ন্যাশনাল টি গার্ডেনের চেয়ারম্যানের পদ দখল করে, কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে এই হারিস। সরকারি জমি দখল, সরকারি বনজ বৃক্ষ বিক্রি, অবৈধভাবে জমি লিজ দেওয়া, ক্রয়-বিক্রয় মূল্যে কারসাজি দেখিয়ে সরকারের চা সেক্টরকেও পঙ্গু করে দেয় সে। এমনকি ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলাকারী জঙ্গিদেরও নিয়মিত অর্ত ও পরিকল্পনা দিতো সে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আদালতে এসব প্রমাণিত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.