ড. প্রণব কুমার পান্ডেঃ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচনি হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আগের বছরগুলোর মতো নির্বাচন আসন্ন হওয়ায় সরকারি দল এবং বিরোধী দল বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে গত প্রায় ১৪ বছরের উন্নয়নের বিষয়টি জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ঠিক তেমনি বিরোধী দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন বয়কট এবং ক্ষমতা থেকে সরকারকে নামিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। বিরোধী দলের এই ধরনের বক্তব্য ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। তখন এই দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করা হবে মর্মে ঘোষণা প্রদান করেছিল। তারা একই সঙ্গে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা প্রদান করেছিল।
তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হলেও এই জোটটি ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রতিহত করার নামে বিভিন্ন ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় তিন মাসব্যাপী হরতাল পালন করার সঙ্গে সঙ্গে পেট্রোলবোমার মাধ্যমে জনগণের জীবন বিপন্ন করে তুলেছিল তারা। সে সময় পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়ে শত শত মানুষ যেমন মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়েছিল, ঠিক তেমনি কয়েক হাজার মানুষ অগ্নিদগ্ধ শরীর নিয়ে অতীব যন্ত্রণার সাথে বেঁচে আছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও একই ধরনের বক্তব্য আমরা শুনেছিলাম বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে। তবে পরে সেই জোট অংশগ্রহণ করে হেরে গিয়ে নির্বাচনকে অবৈধ হিসেবে আখ্যা দেয়। নির্বাচনে জিতে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করার পর থেকে এই দলটি একদিকে যেমন সরকারকে অবৈধ বলে আখ্যায়িত করে চলেছে, অন্যদিকে সরকার পতনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় বিএনপি নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেনি। একই সাথে নির্বাচন কমিশন সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যখন আলোচনা করে, সেই আলোচনাতে এই দলটি অংশগ্রহণ করেনি। তাদের এই কার্যক্রমের মাধ্যমে এটি পরিষ্কার হয়েছে যে নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের আস্থা নেই। ফলে তারা একদিকে যেমন বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, ঠিক তেমনি এই নির্বাচন কমিশনকে বাতিল করে নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারেও দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
কয়েক মাস ধরে বিএনপি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনসমাবেশ করছে। রণকৌশল অনুযায়ী সেই সমাবেশ থেকে কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের সমর্থকদের উজ্জীবিত করার জন্য আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য প্রদান করছে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে এই দলটি বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে জনসমাবেশ করছে। তাদের মূল পরিকল্পনা বিভাগীয় শহরে সমাবেশ শেষে ঢাকায় মহাসমাবেশ করে নির্বাচনের রূপরেখা প্রদান করা।
গত ৮ অক্টোবর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক আলোচনা সভায় বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান ঘোষণা করেছেন আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক জিয়ার নির্দেশে। তার এই বক্তব্য যদি আমরা গ্রহণও করি তাহলে যে বিষয়টি দেখার তা হলো, আগামী ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে বর্তমান সরকারের পতন নিশ্চিত করা। যদি তারা সেটি করতে পারে তারপরেই শুধু বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের নির্দেশেই নতুন ধরনের সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হতে পারে, যা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব বলেই মনে হয়।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে রাজনীতিতে এরকম একটি সমীকরণ বাস্তবায়ন হতে চলেছে, তাহলে বিএনপি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলছে তার কি হবে? যদি বিএনপি নেতাদের নির্দেশে সরকার পরিচালিত হয় তাহলে ধরে নিতে হবে সেই সরকার বিএনপি সমর্থিত সরকার, যাকে কোনোভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা যাবে না। ফলে, তাদের বক্তব্য যদি বাস্তবে রূপ নেয় তাহলে আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে বিএনপির সমর্থনপুষ্ট কিংবা বিএনপিকে সমর্থন করবে এরকম একটি সরকার ব্যবস্থা দেশ শাসন করবে। এই বক্তব্য অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক দাবি থেকে সরে বিএনপি নিজেদের সমর্থিত একটি সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসতে চায়। বিএনপি নেতাদের এই দ্বিচারিতা জাতিকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না বলেই আমি মনে করি।
এরপরের আলোচনা হলো বিএনপির আল্টিমেটাম নিয়ে। আল্টিমেটাম দিয়ে কি সরকার পতন করা সম্ভব? বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন। তারা এটুকু নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে বুঝেছে যে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই ধরনের কাল্পনিক বক্তব্য উপস্থাপন করছে, যা জনগণ প্রত্যাখ্যান করবে। দেশে এমন কোনও অবস্থা তৈরি তৈরি হয়নি কিংবা বিএনপি সাংগঠনিকভাবে এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি যে দিন তারিখ দিয়ে সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে সক্ষম হবে। বর্তমান সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়ে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নতুনভাবে সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজন করতে হলে যে পরিমাণ সাংগঠনিক শক্তি বিএনপির প্রয়োজন তা দলটির নেই। একই সাথে এই ধরনের ঘটনার ঘটানোর জন্য জনসমর্থনের প্রয়োজন হয়, যা সেই দলটির নেই।
রাজনীতিতে আল্টিমেটামের খেলা একটি কৌশল। এই ধরনের আল্টিমেটামের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো চেষ্টা করে জনগণকে তাদের পক্ষে নিয়ে আসাতে। যারা এই ধরনের আল্টিমেটাম দেয় তাদের উদ্দেশ্য থাকে জনমনে এক ধরনের ভীতির সঞ্চার করা, যাতে জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে তাদের পক্ষে অবস্থান নেয় এই ভেবে যে হয়তো আগামী দিনে এমন কোনও ধরনের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ধরনের আল্টিমেটাম দেওয়ার ঘটনা আগেও বহুবার ঘটেছে। দেশের জনগণ দেখেছে যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে সরকারের পতন হয়নি। ফলে, বিএনপির এই আল্টিমেটাম নিয়ে চিন্তার কোনও কারণ নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি না দেশে এমন কোনও ঘটনা ঘটবে, যার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালিত হবে বেগম খালেদা জিয়া কিংবা তারেক জিয়ার নির্দেশে। যারা এই ধরনের অপপ্রচারে বিশ্বাস করছেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে রাজনৈতিক দলের প্রধান কাজ হলো ক্ষমতায় যাওয়া। কারণ, ক্ষমতায় যাওয়ার মাধ্যমেই তারা জনগণকে সেবা প্রদান করতে চায়। এদিক থেকে বিচার করলে সব রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে ক্ষমতায় গিয়ে জনগণকে সেবা প্রদান করা। ফলে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে। রাজনীতিতে কৌশল যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস অর্জন করতে ব্যর্থ রাজনৈতিক দল কখনোই ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করতে পারবে না।
একই সাথে রাজনৈতিক দলগুলো যদি কৌশল নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাহলে সেটি অনেক সময় রাজনৈতিক দলকে রাজনীতির আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে, যেমনটি ঘটেছিল বিএনপির ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে। সেই ভুল সিদ্ধান্তটি দলকে অনেকটা ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে। সে অবস্থা থেকে ফিরতে হলে একদিকে যেমন দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে দলের নীতি, আদর্শ এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে জনগণকে আস্থায় নিতে হয়, যা দলটি করতে ব্যর্থ হয়েছে বছরের পর বছর।
অন্যদিকে, গত প্রায় ১৪ বছরে বাংলাদেশের যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে তার প্রেক্ষাপটে এ কথা নিশ্চিত বলা যায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দেশবাসীর আস্থা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। দেশবাসী বিশ্বাস করেন, বঙ্গবন্ধু যেমন বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে যোগ্যতম মানুষটি হচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে, গত নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় এবারও বাংলাদেশের জনগণ তাঁর নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখবে বলে আমার মনে হয়।
ফলে, এই ধরনের বিভ্রান্তিকর এবং ভিত্তিহীন আল্টিমেটাম দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কোনও ফায়দা লুটতে পারবে না। দেশবাসীর উচিত কোনও প্রোপাগান্ডায় বিশ্বাস না করে দেশে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় কাজ করা। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বিএনপি জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ভিত্তিহীন আল্টিমেটাম দিয়েছেন, যা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবতা বিবর্জিত।
লেখক: অধ্যাপক, লোক–প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
সৌজন্যেঃ বাংলা ট্রিবিউন