প্রশান্তি ডেক্স॥ যশোর শহরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা খুলনা বাসস্ট্যান্ড মণিহার মোড়। তিন রাস্তার সংযোগস্থল। পাশে ঢাকা রোড জামে মসজিদ। মসজিদের প্রধান ফটকের সঙ্গে লাগোয়া একটি ঝুপড়ি ঘর। কোনোমতে তিন জন সেখানে দাঁড়িয়ে বানাচ্ছেন আলু পুরি। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলে পুরি তৈরি ও বিক্রির কাজ। বলা যায়, এখানে আলু পুরি বিক্রির রাজত্ব করছেন মো. বশির শেখ। দিনে চার হাজার ৫০০ টাকার পুরি বিক্রি করেন। সেইসঙ্গে আরও পাঁচ-ছয় হাজার টাকার লুচি, বেগুনি ও পেঁয়াজু বিক্রি করেন। সব খরচ বাদ দিয়ে দিনে এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় তার।
বশির শেখের আলু পুরির যেমন সুনাম আছে তেমনি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেটি হলো আলু পুরির সঙ্গে বুটের ডাল ফ্রি দেন। দাম রাখেন প্রতি পিস তিন টাকা। পাশাপাশি লুচি, বেগুনি ও পেঁয়াজুর একই দাম রাখেন। সবকিছুর দাম বাড়লেও পুরি-লুচির দাম বাড়াননি তিনি।
ঝুপড়ি ঘরের পাশে বেঞ্চে বসে পুরি খাচ্ছিলেন শহরের সিটি কলেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা সিদ্দিক হোসেন (৫২)। প্রায় প্রতিদিন এখানে আলু পুরি খেতে আসেন তিনি। সিদ্দিক হোসেন বলেন, ‘৩২ বছর ধরে এখানে পুরি খাই। পাঁচটি পুরি খেয়েছি এখন। দাম ১৫ টাকা। বশির মিয়ার আলু পুরি অনেক সুস্বাদু। সঙ্গে ডাল ফ্রি। খেতে খুব ভালো লাগে। সবকিছুর দাম বাড়লেও স্বাদের পরিবর্তন হয়নি এখনও।’
ঝুপড়ি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পুরি খাচ্ছিলেন যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী আখতারুজ্জামান ও বিএএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান। তারা জানান, খুলনা বাসস্ট্যান্ডে এসেছিলেন বাসের টিকিট কিনতে। দূর থেকে লোকজনের পুরি খাওয়া দেখে এসেছেন। নিজেরাও খেয়েছেন। খুবই মজা লেগেছে তাদের।
বশির শেখ বলেন, ‘১৯৮০ সালের দিকে এই মোড়ে মন্টু মিয়ার (স্থানীয় বাসিন্দা) পুরির দোকান ছিল। তার দোকানে কাজ করতাম। আলু পুরি তৈরির কাজ তার কাছেই শিখেছি। ১৯৮৫ সালে নিজেই আলু পুরি তৈরি ও বিক্রি শুরু করি। তখন ঝুপড়ি ঘর ভাড়া বাবদ মাসে মসজিদ কমিটিকে এক টাকা করে দিতাম। সেই থেকে আছি; এখন প্রতি মাসে ভাড়া দিই ৭০০ টাকা।’
এই মোড়ে ঢাকা, বরিশাল ও রংপুরসহ বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী পরিবহনের কাউন্টার রয়েছে অর্ধশতাধিক। পাশেই কেশবপুর বাসস্ট্যান্ড, মণিহার সিনেমা হল, নড়াইল বাসস্ট্যান্ড, মোটর পার্টস ব্যবসায়ীদের দোকান ছাড়াও রয়েছে গ্যারেজ। প্রতিদিন এই স্থান হাজারো মানুষের পদচারণায় মুখর থাকে।
বশির শেখ বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল ৭টায় দোকান খুলি। এরপর লুচি বানাই। লুচির সঙ্গে ডাল দিই। লুচি তিন টাকা ও ডাল পাঁচ টাকা রাখি। এগুলো বিক্রির পরপরই তৈরি করি আলু পুরি। চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। দোকান বন্ধ করতে ৯টা বেজে যায়। তবে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের লুচির সঙ্গে ডাল ফ্রি দিই। দোকানের বেশিরভাগ পুরি বিক্রি হয় পার্সেলে। লোকজন খায়, আবার সঙ্গে বাড়ির সদস্যদের জন্য নিয়ে যান। ৩৭ বছর ধরে এভাবেই চলছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ১৮-২০ কেজি ময়দা, ২৫ কেজি আলু, পাম অয়েল ৯-১০ লিটার, পেঁয়াজ পাঁচ কেজি, বেগুন পাঁচ কেজি, বেসন ও ছোলা ইত্যাদি কেনা লাগে। দিনে ১৫০০-১৬০০ পুরি বিক্রি হয়। পাশাপাশি লুচি, বেগুনি ও পেঁয়াজুসহ ১০-১২ হাজার টাকার বেচাকেনা হয়। তবে খরচও হয় বেশ। মালামাল কেনা, কর্মচারীর বেতন ও দোকান ভাড়া বাদ দিয়ে দিনে হাজার খানেক আয় হয়। কখনও কখন ১৫শ টাকা আয় হয়।’
বশির শেখ বলেন, ‘এক কেজি ময়দায় পুরি হয় ১২০টি, লুচি ১০০টি। আলু পুরির দাম আগে তিন টাকা ছিল, এখনও তাই। বাড়াইনি। কিন্তু ময়দায় ১০-১৫ টাকা, পাম অয়েলে ৩০-৪০ টাকা, কেরোসিনে ৪০ টাকা, বুটের ডাল কেজিতে ৩০ টাকা বেড়েছে। দাম বাড়ালে ক্রেতা কমবে এজন্য বাড়াইনি। আগের চেয়ে আয় সীমিত। তবে বিক্রি বেশি হওয়ায় লাভ হয়।’
বশির শেখের বাবার নাম সরোয়ার জাহান। তিনি পুলিশের কনস্টেবল ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। যশোর কোতোয়ালি থানা অভ্যন্তরে গণকবরে শায়িত আছেন। পরে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পান। বশির শেখের মা হামিদা খাতুন মারা গেছেন তিন বছর আগে। তারা পাঁচ ভাই দুই বোন। বাবার ভাতার টাকা ভাগ করে নেন ভাইবোনেরা।
তাদের বাড়ি ছিল বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায়। বর্তমানে বশির শেখ যশোর শহরের নাজির শংকরপুর এলাকায় তিন কাঠা জমি কিনে টিনশেড ঘরে থাকেন। দুই ছেলে চার মেয়ে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা পৃথক। স্ত্রী, এক মেয়ে ও দুই নাতি-নাতনি নিয়ে তার সংসার।