প্রশান্তি ডেক্স॥ বিজয়ের মাস ডিসেম্বর! তবে এবার এই মাসটিকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে এসেছে নতুন মাত্রা। ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনুমতি দেওয়া হলেও নয়া পল্টনেই সমাবেশ আয়োজনে অনড় বিএনপি। দুই পক্ষের এই অটল অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কা তৈরি হলেও আদতে অনেকটাই শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রাখার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত একাধিক পক্ষের সঙ্গে আলাপকালে এ বিষয়টি উঠে আসে।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, সরকারি দলও বিএনপির আন্দোলন ইস্যুতে কিছুটা নমনীয়। বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার স্বার্থে সরকারি দল নিজেদের একটি পূর্বঘোষিত কর্মসূচির সময় পরিবর্তন করেছে। দলটি ওই দিন রাজধানীতে সতর্ক অবস্থানে থাকবে বলে ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, শেষ মুহূর্তে নয়া পল্টনেই সমাবেশ করার অনুমতি পাবে বিএনপি। গত মঙ্গলবার (২৯ নভেম্বর) ডিএমপির পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও বিএনপির এতে সায় নেই। বিশেষত যে ২৬টি শর্তে বিএনপিকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেসব শর্ত মানা হলে সমাবেশ করারই সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন বিএনপির নেতারা।
ডিসেম্বরজুড়ে মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ, পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রাখার প্রত্যাশা : সরকারি দলের সূত্রগুলো জানিয়েছে, কাগুজে শর্ত কঠিন হলেও বাস্তবে ততটা কড়াকড়ি আরোপ করা হবে না। বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে চাইলে সেটা নির্বিঘ্নে করতে পারবে। তবে সমাবেশকে কেন্দ্র করে কোনও বিশৃঙ্খলা করতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোরভাবে মোকাবিলা করবে।
আওয়ামী লীগ সূত্র জানিয়েছে, ১০ ডিসেম্বর ইস্যুতে বিএনপি তার কঠোর অবস্থান পরিবর্তন করার কারণে সরকারও তার কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ইতোমধ্যে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। এজন্য আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন দুদিন এগিয়ে আনা হয়েছে।
রাজধানীর বাইরে অনুষ্ঠিত বিএনপির সব জনসভাকে কেন্দ্র করে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক এলেও ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে কেউ যেন পরিবহন ধর্মঘট ডাকতে না পারে সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন নেতারা। অবশ্য দলীয়ভাবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণসহ দলের সহযোগী সংগঠন ওইদিন ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কার্যালয়ে সতর্ক থাকবে।
১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে প্রস্তুতি থাকার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ডিসেম্বর মাসব্যাপী রাজনীতিতে সক্রিয় অবস্থানে থাকবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম ও ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজারে জনসভায় বক্তব্য রাখবেন। এছাড়া ৬ ও ৭ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের সম্মেলন হবে। ১৫ ডিসেম্বর হবে সহযোগী সংগঠন যুব মহিলা লীগের জাতীয় সম্মেলন। এছাড়া ২৪ ডিসেম্বর হবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন।
আওয়ামী লীগ ১০ ডিসেম্বর সতর্ক পাহারায় থাকবে বলে জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গত বুধবার (৩০ নভেম্বর) সচিবালয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, পার্টি অফিসে সমাবেশ করার জন্য বিএনপির এত দৃঢ়তা কেন? এখানে তাদের কি কোনও বদ উদ্দেশ্য আছে? কোন মতলবে তারা এটা চায়? সমাবেশকে ঘিরে আন্দোলনের নামে সহিংসতা হলে সমুচিত জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে কাদের বলেন, আমরা বাধা দিতে চাই না। বিএনপি সমাবেশ করুক শান্তিপূর্ণ পরিবেশে—এটাই আমরা চাই। অবশ্য মঙ্গলবার দিনাজপুরে এক অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপির সমাবেশে আওয়ামী লীগের একজন নেতাকর্মীও তাদের ধারে-কাছে যাবে না।
বিএনপির প্রত্যাশা অনুযায়ী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হলো দাবি করে বুধবার রাজারবাগে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সুন্দর পরিবেশের জন্যই তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ আমাদের প্রতিনিধিকে জানান, বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেটে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করবে। তিনি জানান, এছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ১০ ডিসেম্বর ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউসহ রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করবে।
রিয়াজ উদ্দিন বলেন, বিএনপি যাতে সমাবেশের নামে সন্ত্রাস-জঙ্গি হামলা করতে না পারে সেজন্য আমরা সতর্ক থাকবো। তারা জানমালের ক্ষতি করতে গেলে সমুচিত জবাব দেওয়া হবে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্ল্যাহ বলেন, আমরা তাদের সমাবেশকে স্বাগত জানাই। তারা ঘোষণা দিয়েছে ১০ লাখ লোক উপস্থিত করবে। ১০ লাখ লোক জোগাড় করে দেখাক। তারপর দেখা যাবে। ১০ লাখ লোক যখন জোগাড় করতে পারবে তখন খেলা হবে। এর আগে ওদের সঙ্গে কীসের খেলা?
স্বাভাবিক গণসমাবেশ করবে বিএনপি, আসবে নতুন বার্তা ও কর্মসূচি :
বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে বিএনপির যে সমাবেশ শুরু হয়েছে তা আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় শেষ হবে। অন্যান্য বিভাগীয় কর্মসূচির মতো এই সমাবেশও অনেকটা একই। তবে নতুনভাবে এই সমাবেশ থেকে কর্মসূচি দেবে বিএনপি। পাশাপাশি সরকার ও দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট বার্তা দেবেন দলটির নেতারা।
যদিও গত অক্টোবরে বিএনপির মধ্যম সারির কয়েকজন নেতা ঢাকার সমাবেশকে কেন্দ্র করে ‘রাজনৈতিক উচ্চবাচ্য’ করায় সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। কোনও কোনও নেতা ‘সমাবেশে খালেদা জিয়া উপস্থিত হবে’, ‘তার কথায় দেশ চলবে’ এমন বক্তব্য দিলেও দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কড়া নির্দেশে তা পরবর্তী সময়ে পরিহার করেন বিএনপির নেতারা।
চেয়ারপারসন কার্যালয়ের প্রভাবশালী একজনের ভাষ্য, বিএনপির লক্ষ্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই গত অক্টোবর থেকে বিভাগীয় গণসমাবেশ করছে বিএনপি। এই ডিসেম্বরের মধ্যেই যেন জনগণের প্রত্যাশা ও দাবিকে চূড়ায় নেওয়া সম্ভব হয়, সে কারণে অক্টোবর থেকে সমাবেশ ডেকেছেন নেতারা। বিগত সময়ের মতো কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি। কোনোভাবেই এই সরকারকে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ করে দিতে চান না বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।
দলের স্থায়ী কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য বলেন, ১০ ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক কী কর্মসূচি ও কী বার্তা দেওয়া হবে, তা নিয়ে একটি বৈঠক হবে। সে বৈঠকেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে কী কী আসছে গণসমাবেশে। তবে এখন পর্যন্ত সমাবেশ থেকে নতুন কর্মসূচি দেওয়ার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত।
দলের কোনও কোনও নেতা রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা আগেই দেওয়ার পক্ষে মত দিলে এতে সমাবেশের প্রতি মানুষ আগ্রহ হারাবে, এমন শঙ্কায় তা বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানান নির্ভরযোগ্য একজন নেতা।
এ বিষয়ে গত বুধবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘যারা সহিংসতা চায়, তারাই সহিংসতা বলে বিষয়টিকে সেদিকে নিতে চায়। বিএনপির আন্দোলন সংগ্রাম শান্তিপূর্ণ। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশও হবে শান্তিপূর্ণ। যারা বলছে সহিংসতা, সেটা তাদের রাজনীতির মধ্যে নিহিত আছে। আমরা কেন সহিংসতা করবো। আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন, কর্মসূচি চলছে। এটা চলবে সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত।’
অনুমতি মিলবে পল্টনে, সমাবেশ হবে ‘শান্তিপূর্ণ’ :
সরকারি দল ও বিরোধী দলের নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের ফলে রাজনৈতিক মহলে ১০ ডিসেম্বর নিয়ে উত্তেজনা ছড়ালেও আদতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হচ্ছে বলে জানান বিএনপির ও বিরোধী দলের নেতারা।
গত ২২ নভেম্বর নয়া পল্টনের সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খুব পরিষ্কার করে বলেছি আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করবো। এখনও তো আসল ঘোষণা দিইনি। আসল ঘোষণা আসবে ১০ তারিখে। সেদিন থেকে শুরু হবে এক দফার আন্দোলন। সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে আগ্রহী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা আশা করছেন, ঢাকার গণসমাবেশ থেকে বিএনপি রাজনৈতিক লক্ষ্য বিস্তারিতভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরা হবে। তারা আশা করছেন– এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত যে তথ্য, তাতে বিভাগীয় সমাবেশ নিশ্চিতভাবেই শান্তিপূর্ণ হবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা সাইফুল হক মনে করছেন, সরকারের পক্ষ থেকে বা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে কোনও উসকানি দেওয়া না হলে বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হবে। তিনি বলেন, ‘বিএনপির গণসমাবেশ কোনও চূড়ান্ত কর্মসূচি নয়, আখেরি কর্মসূচি নয়। এটা আন্দোলনের একটি পর্যায় মাত্র। সরকারের পক্ষ থেকে কোনও বাধা, সংঘাত সৃষ্টি করা না হলে সমাবেশও শান্তিপূর্ণ হবে। কিন্তু সরকার যা করছে, তাতে তারা গণ-আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে।’
সমাবেশের অনুমতি শেষ পর্যন্ত নয়া পল্টনেই মিলবে, এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন বিএনপির একজন দায়িত্বশীল। তিনি উল্লেখ করেন, স্থান নিয়ে সরকারের বিরোধিতা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিষয়টি এসেছে বিএনপিকে চাপে রাখার জন্য। তবে শেষ পর্যন্ত পল্টনেই অনুমতি মিলবে। কেউ কেউ এ বিষয়ে ভূমিকা রাখবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন এই দায়িত্বশীল।
গত বুধবার (৩০ নভেম্বর) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আবারও বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী জানিয়েছেন, বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি চায়নি।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির উল্লেখ করেন, ‘বিএনপি ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছে। অতীতের চেয়ে ভিন্ন। এটা সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।’