প্রশান্তি ডেক্স॥ ১৯৭১ সালে যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গী ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। কিন্তু শত্রুর কানে যেন না পৌঁছায় সে কারণে যতটা সম্ভব কণ্ঠ নামিয়ে সেটি শোনা হতো। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরে কোথাও কোথাও উচ্চস্বরে সেই বক্তৃতা আবারও শোনা যেতে লাগলো। বাংলার মানুষ তখন গ্রামের কোনও কোনও এলাকায় ফিরতেও শুরু করেছে।
এদিন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত লেখেন, ‘নিশান উড়ছে চুয়াডাঙ্গায়। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ঝিনাইদহ থেকে এগিয়ে কুষ্টিয়ার উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে। কুমিল্লার ময়নামতি পাকিস্তানিদের হাতে তখনও। তবে তাদের পালাবার সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ময়নামতির আশপাশের পাহাড়ে শত্রু সৈন্য নেই। এদিকে যশোর এলাকায় ভারতীয় সেনা এক হাজার টনের মতো গোলাবারুদ এমনিতেই পেয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী পালানোর সময় সেগুলো ফেলে গেছে। ভারতীয় বাহিনী ক্রমে খুলনার দিকে যাচ্ছে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয় যে কোনও শত্রু যাতে জলপথে পালাতে না পারে, সেজন্য নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে নজর রাখছে। ভারতীয় বাহিনী এখন মেঘনার তীরে চাঁদপুরের পূর্ব দিকে চলেছে। সেখান থেকে নদীর ওপর নজর রেখে চলেছে।’ নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে এই দিনের পত্রিকায় বলা হয়—‘বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে শত্রু সৈন্য নিশ্চিহ্ন করার জন্য রাতে বিমানপথে আঘাত করা হচ্ছে।’
সরেজমিন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে প্রতিবেদক অমিয় দেবরায় বলছেন, ‘৯ ডিসেম্বর সীমান্ত পেরিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতে যেতে দেখলাম—পথের ধারে পাক সেনাদের পরিত্যক্ত শত শত বাংকার পড়ে আছে। সারা শহর আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছে। মাইকে মুজিবের গলা শুনে চমকে উঠলাম। মুজিব কি ফিরে এসেছেন? তারপরেই বিভ্রান্তি দূর হয়, না মুজিব নয়। এটা মুজিবের কণ্ঠস্বর। ৭ মার্চ রেকর্ড করা ঢাকার মাঠে দেওয়া তার ঐতিহাসিক বক্তৃতাটির রেকর্ড চালিয়ে লোকে বারবার তার কণ্ঠস্বর শুনছে। এখান থেকে আখাউড়া ১৩/১৪ মাইল। আমরা তখন আখাউড়ার দিকে এগোচ্ছি। দেখি, বহু লোক যারা বাড়িঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তারা ফিরে আসছেন।’ সেখানে অমিয় দেবরায়ের কথা হয় ফিরতে শুরু করা মানুষদের সঙ্গে। তারা বলেন, গত চার মাসের মধ্যে এই প্রথম গ্রামে ফেরার সুযোগ হচ্ছে। এর আগে পাক সেনাদের ভয়ে তারা নিজ গ্রামে আসতে পারেননি।
একই দিনের পত্রিকায় শিলিগুড়ি থেকে দীনেন চক্রবর্তী জানান, ভারতীয় সেনাবাহিনী উত্তর রণাঙ্গনে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রংপুর জেলার পলাশবাড়ী ও সাদুল্লাহপুর দখল করে নিয়েছে। বলা বাহুল্য, সামরিক দিক থেকে এ দুটি ঘাঁটি দখল ছিল ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলে রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলায় পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এখন সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন এবং অবরুদ্ধ। কোনও দিক থেকে পালাবার রাস্তা নেই। যমুনা পেরিয়ে যেতে পারলেই ঢাকা। সেখানেও তাদের যাওয়ার কোনও উপায় তখন আর নেই। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন পদস্থ অফিসার সাংবাদিকদের বলেন, রংপুর জেলার গাইবান্ধার উত্তরের রেলপথগুলো সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। ফলে এই পথের রেল যোগাযোগ আর হচ্ছে না।
এই দিনে সবদিক থেকে প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে—ঢাকা এবং কেন্দ্রের যুদ্ধ। ঢাকার যুদ্ধে অংশ নিতে সম্মিলিত বাহিনী প্রস্তুত এবং চতুর্দিক থেকে সব কয়টি বাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ঢাকা থেকে পাক বাহিনীর পালাবার পথ যেমন রুদ্ধ, তেমনই অন্য স্থান থেকে পালিয়ে ঢাকায় আসার পথও রুদ্ধ। পাক বাহিনী ঢাকাতে আটকা পড়ে গেলো। খুব দ্রুত কীভাবে ঢাকা পৌঁছানো যায়, তার উদ্যোগ আয়োজন তখন মোটামুটি চূড়ান্ত। সামনেই ঢাকা। সম্মিলিত বাহিনীর চোখে-মুখে দৃঢ়তার উজ্জ্বল জ্যোতি। লড়াই চলছে বাংলাদেশের ফ্রন্ট ফ্রন্টে।
এই সময়ই আরেকটি ঘটনা ঘটলো পাকিস্তানি শিবিরে। জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন রওনা হন নিউ ইয়র্কের পথে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে। যাওয়ার আগে তিনি ঘোষণা দেন—সেখানে গিয়ে তিনি যুদ্ধ বিষয়ে প্রকৃত অবস্থা বোঝাবেন। কিন্তু এদিকের প্রকৃত অবস্থাটা হচ্ছে—জেনারেল মানেকশ আত্মসমর্পণের নির্দেশ সংবলিত লিফলেট বিমান থেকে ফেলছেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এদিন এক আবেদনে বাংলাদেশে ভারতীয় সাহায্য দ্রুততর করার আহ্বান জানান।
ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক ঢাকার যুদ্ধ বিষয়ে বলতে গিয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তখন অলরেডি হাতে হাতে লিফলেট চলে আসতে শুরু করেছে। পাকিস্তানি ঘাঁটিতে ফেলা হলেও সেগুলো সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে যেতে সময় লাগেনি। আমরা তখনও ঢাকায় যুদ্ধটা কোন সময় হয়, সেই বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম। এর পরের কয়েক দিন দ্রুত সিদ্ধান্ত বদলে গিয়ে আত্মসমর্পণের পথ স্পষ্ট হতে থাকে।