প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স॥ ফুটবলকেই নিজের পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছিলেন পেলে! লড়াই থামলো ফুটবল সম্প্রাটের। দীর্ঘ এক মাসের বেশি সময় কেটেছে হাসপাতালে। পরিবারের সদস্যদের বিনিদ্র রাত কাটছিল। বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন জুড়ে গিয়েছিলেন তাঁর নামের সঙ্গে। সেই নাম ক’জন জানেন? বাবা জোয়াও রামোস ডু নাসিমেন্টো ছিলেন ফুটবলার। প্রচুর গোলও করতেন। তিনি আর তাঁর স্ত্রী সেলেস্তে আরান্তেস ছেলেকে ডাকতেন ডিকো বলে। সেই ডাকনামও যে তলিয়ে যাবে স্মৃতির চোরাবালিতে, কে জানত! এমনকি, যে নামে সারা বিশ্ব চিনল, তাও ছিল না তাঁর নাম। ভাস্কো দ্য গামার গোলকিপার বিলে ছিলেন ছেলেবেলার হিরো। চেয়েছিলেন, স্কুলের বন্ধুরা বিলে নামেই ডাকুক। হল উল্টোটা। বিলের বদলে পেলে নাম ধরে রাগাতে শুরু করল বন্ধুরা। কে জানত, রাগানোর জন্য ব্যবহার করা ওই নামই একদিন সোনার অক্ষরে লিখতে হবে স্কুলের বন্ধুদের? ফুটবল বিশ্বে চিরকাল অমর থেকে যাবেন! দারিদ্র, সাফল্য, স্বপ্নপূরণ, ব্রাজিল, এমনকি ফুটবলও হয়ে যাবে পেলে নামের সমার্থক!
খেলার এই এক মহিমা। কেউ কেউ জায়গা পেয়ে যান খেলারই হৃদয়ে। প্রিয় ছাত্র তখন হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি। কেউ কেউ ছাপিয়ে যান খেলাটাকেই। ক্রিকেটে যেমন ডন ব্র্যাডম্যান। বক্সিংয়ে যেমন মহম্মদ আলি। ফুটবলে তেমন পেলে। গ্যারিঞ্চা, ভাভা, দিদারা এসেছেন। কিংবদন্তি হয়েছেন। মারাদোনা, মেসি, রোনাল্ডোরা এসেছেন। কিংবদন্তি হয়েছেন। কিন্তু খেলার উর্ধ্বে উঠতে পারেননি। পেলেকে দেখার জন্য থেমে গিয়েছে যুদ্ধ। মুছে গিয়েছে সামাজিক ভেদাভেদ। দুঃখ, যন্ত্রণা এমনকি প্রিয়জনের মৃত্যু ভুলেও ছুটে এসেছে অগণিত মানুষ। জাতীয় সম্পদ ঘোষিত হয়েছেন। দেশের দুর্নীতি মুছতে ক্রীড়ামন্ত্রী বাছতে হয়েছে তাঁকে। ফুটবল আসলে সেতু ছিল তাঁর। জীবন বদলের গানই শুনিয়েছেন পেলে।
তীব্র গতি, ভীষণ শক্তিশালী, ক্ষুরধার মস্তিষ্ক, পরিস্থিতি অনুযায়ী মুহূর্তে নিজেকে পাল্টে ফেলা, আকন্ঠ টিমম্যান- মাঠ ও মাঠের বাইরে পেলে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই ক’টা শব্দই গত ষাট বছর ধরে ব্যবহার করেছেন ভক্ত থেকে বিশেষজ্ঞ। বাবা ফুটবলার হলেও অসম্ভব দারিদ্র ঠেলে সাফল্যের এভারেস্টে উঠেছিলেন পেলে। একটি ফুটবল ম্যাচ খেলতে গিয়ে পা ভেঙে যায় বাবার। ছোট্ট পেলের কাছে তখন থেকেই দুনিয়া হয়ে গিয়েছিল অসংখ্য গোলকিপারে ঢাকা পড়া একটা গোলপোস্ট। চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়েছে ছেলেবেলায়। যাতে আর্থিক স্বচ্ছন্দ দেওয়া যায় পরিবারকে। যাতে হাসি ফুটিয়ে তোলা যায় বাবা-মার মুখে। সেই ছেলেবেলা থেকেই পেলে ছিলেন টিমম্যান। নিজে জিততে চেয়েছেন। জেতাতে চেয়েছেন টিমকে। পরিবারের ক্ষেত্রে, ব্রাজিলের ক্ষেত্রে সেই পেলেকেই বারবার চিনেছে বিশ্ব।
১১ বছর বয়সে পেলে পেয়ে গেলেন ফুটবল সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়ার সুযোগ। অথবা, ফুটবল পেয়ে গেল তার সম্রাট! সে সময় ব্রাজিলের অত্যন্ত নামী ফুটবলার ওয়াল্টার ডি’ব্রিটো স্কাউটিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন। নতুন প্রতিভা তুলে আনার জন্য ব্রাজিলের অলি-গলি ঘুরছিলেন ব্রিটো। মিনাসের ছোট্ট শহর ত্রেস কোরাসোয়েসে গিয়ে এক বিস্ময় প্রতিভার খোঁজ পেলেন। ১১ বছরের কিশোর। কিন্তু গোলটা অসম্ভব চেনে। দুরন্ত ড্রিবল পায়ে। দু’পায়ে জোরালো শট। সবচেয়ে বড় কথা, ওই পুঁচকে ছেলের আশ্চর্য জয়ের খিদে। ব্রিটো বুঝেছিলেন, ব্ল্যাক পার্ল খুঁজে পেয়েছেন তিনি। টানা দু’বছর কোচিং দিলেন। ব্রিটোই রাজি করালেন বাবা-মা জোয়াও আর আরান্তেসকে। সান্তোসে ট্রায়াল দিলেন পেলে। তখন বয়স মাত্র ১৫। ট্রায়ালে দেখেই কোচ লুলা বুঝেছিলেন, এ ছেলে অনেক দূর যাবে। ব্রিটো আর লুলার জন্য পেলেকে সই করাতে দেরি করেনি স্যান্টোস। সিনিয়র টিমের সঙ্গে প্র্যাক্টিস করতে করতে ১৯৫৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পেলে খেললেন তাঁর প্রথম পেশাদার। কোরিন্থিয়ান্সের বিরুদ্ধে স্যান্টোস জিতেছিল ৭-১। অভিষেক ম্যাচে ৪ গোল করে চমকে দিয়েছিলেন পেলে। স্যান্টোসের সমর্থকরা, মিডিয়া এবং ব্রাজিলের ফুটবল ভক্তরা জেনে গেল, এক বিস্ময় বালকের আবির্ভাব হয়েছে।
আরও বছর খানেক পর আন্তর্জাতিক আঙিনায় পা রাখবেন তিনি। সেটাও জুলাই মাসের এক ৭ তারিখ। পেলের অভিষেক ম্যাচের সাক্ষী থাকবে ঠাসাঠাসি মারাকানো স্টেডিয়াম। সাক্ষী থাকবে আর্জেন্টিনা। ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে ব্রাজিলের হয়ে অভিষেক ম্যাচেই গোল করবেন পেলে। আর এক বছর পর, ১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপ জিতবেন। ব্রাজিলের প্রথম, নিজেরও।
তখনও সাবালক হননি পেলে। বয়স মাত্র ১৭। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে সুইডেনের বিরুদ্ধে শেষ গোলটা পেলেরই। নিজেই বর্ণনা দিয়েছিলেন ওই গোলের- খেলা শেষ হতে ১১ মিনিট বাকি। তখনই স্কোরলাইন ৩-১ করি। নিল্টনকে চেঁচিয়ে বলেছিলাম, লম্বা সেন্টার পাঠাতে। ওর সেন্টারটা বুকে নামিয়ে নিয়েছিলাম। সুইডেনের ডিফেন্ডার গুস্তাভসন এগিয়ে আসছিল। ওর মাথার উপর দিয়ে বলটা ফ্লিপ করে এগিয়ে যাই। তারপর, ভলিতে গোল… সেই শুরু। পরের বিশ্বকাপটাও জিতবেন, জেতাবেন দেশকে। ১৯৭০ সালে আবার।
১৯৩০ সাল থেকে বিশ্বকাপের শুরু। তারও অনেক আগে যাত্রা শুরু ফুটবলের। বাস্কেটবল, ফর্মুলা ওয়ান, গল্ফ, ক্রিকেটের মতো খেলাগুলোকে কিভাবে পিছনের সারিতে ফেলল ফুটবল? সহজ উত্তর- পাঁচের দশকের শেষ দিকে পেলের মতো এক তারকার উত্থানে। ছয়ের দশক জুড়ে পেলের ধারাবাহিক সাফল্যে। পেলের আগে, পেলের সময়, পেলের সঙ্গে কি কেউ ছিলেন না? ছিলেন অনেকেই। কিন্তু কেউই পেলের মতো বর্ণময় চরিত্র ছিলেন না। সাফল্যে ভরপুর থাকতে পারেননি। ফুটবলকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি।
তখন ফুটবল চাইছে পেলেকে। আর ইউরোপিয়ান টিমগুলো খুঁজছে ব্রাজিলিয়ান তারকাকে। ১৯৬১ সালে ইংল্যান্ড, ইতালির বেশ কয়েকটা বড় টিম পেলের পিছনে ছুটছে টাকার থলি নিয়ে। পেলে যদি স্যান্টোস ছেড়ে চলে যান, দেশীয় ফুটবলের কী হবে? ওই ভাবনা থেকেই ব্রাজিলের সরকার পেলেকে জাতীয় সম্পদ ঘোষণা করে দিয়েছিল। তার অর্থ ছিল, পেলেকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না! বিখ্যাত ইংলিশ ফুটবল সাংবাদিক লিখেছিলেন, দে স্তেফানো তৈরি হয়েছেন পৃথিবীতে। আর পেলে, তাঁকে তৈরি করেছেন ঈশ্বর!
১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাস। নাইজিরিয়ায় ফুটবল ম্যাচ খেলতে চলেছে স্যান্টোস। দু’বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে নাইজিরিয়ায়। পুরো দেশ বারুদে গন্ধে আচ্ছন্ন, বিপর্যস্ত। স্যান্টোস কি মাঠে নামতে পারবে? ব্রাজিলিয়ান ক্লাবের কর্তারাও সন্দিগ্ধ ছিলেন। কিন্তু পেলে জানতেন, তিনি মাঠে নামবেন। হয়েওছিল তাই। পেলে নাইজিরিয়া সফরে যাচ্ছেন বলে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করা হয়। লাগোসের ক্লাবের বিরুদ্ধে পেলের মাঠে নামার সময় গ্যালারি প্ল্যাকার্ডে, পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল— পেলে খেলতে নামছেন, শান্তি বজায় রাখুন। ওই বছরই নভেম্বর মাসের মারাকানো দেখল এক আশ্চর্য ঘটনা। ঘরোয়া লিগের একটা ম্যাচ খেলতে নেমে পেলে করেছিলেন কেরিয়ারের হাজারতম গোল। স্টেডিয়াম থেকে কাতারে কাতারে মানুষ নেমে পড়েছিলেন মাঠে। আধঘণ্টা ম্যাচ বন্ধ রাখতে হয়েছিল রেফারিকে। ১৯ নভেম্বর পেলের জন্যই স্যান্টোসে শুরু হল ফুটবল দিবস পালন। সেই তিনিই কসমসে গিয়ে আমেরিকার রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিলেন ফুটবল।
কেন পেলে কিংবন্তিরও উর্ধ্বে? কেন পেলে ফুটবলের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত? শুধু ফুটবল দিয়ে কেন মাপা যাবে না পেলেকে? মহানায়কের মঞ্চে উঠে দাঁড়ানো পেলের জীবনের ছত্রে ছত্রে রয়ে গিয়েছে লড়াই। হারিয়ে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। আসলে আমজনতার দারিদ্রতার গল্পকে স্বপ্নের মোড়কে পেশ করেছিলেন পেলে। চায়ের দোকানে কাজ করা একটা বাচ্চা ছেলের ফুটবল পায়ে দৌড়, গোলের সেলিব্রেশন, বিশ্বকাপে চুম্বন আবেগে-অনুষঙ্গে ঢুকে পড়েছিল ব্রাজিলের, বিশ্বের। দুর্নীতি আক্রান্ত ব্রাজিল সরকার তাঁকেই ক্রীড়ামন্ত্রী করত না, ইউনেসকো তাঁকে বিশ্বদূত হিসেবে পেশ করত না। এমনকি, হলিউডের রুপোলি পর্দা সিলভারস্টার স্ট্যালোনের পাশে দাঁড় করিয়ে দিত না পেলেকে!
আসলে পেলেই বেছে নিয়েছিলেন ফুটবলকে। এই পৃথিবীর অসংখ্য স্টেডিয়াম, খেলার মাঠ, অগণিত ভক্ত, এই খেলাটাতে স্থায়ী ছাপ রেখে যাওয়ার জন্য। একটা আস্ত পৃথিবী তৈরি করার জন্য। যে পৃথিবীর নাম— পেলে’জ় ওয়ার্ল্ড!