প্রশান্তি ডেক্স\ গত ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। তবে সেদিন সেখানে কী ঘটনা ঘটেছিল তার বিস্তারিত এখনও অজানা। কিসের ভিত্তিতে তাহলে ভারতীয় স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালক ‘ফারাজ’ ছবিটি নির্মাণ করেছেন? এমন প্রশ্ন রেখেছেন সেদিন জঙ্গি হামলায় নিহত অবিন্তা কবিরের মা রুবা আহমেদ। এই সিনেমায় সেদিনের প্রকৃত ঘটনা উঠে আসবে না বলেও আশঙ্কা তার।
গত বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) রাজধানীর শাহজাদপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেতে যাওয়া এই মুভির বিষয়ে নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে বেশকিছু বিষয় তুলে ধরেন রুবা আহমেদ।
তিনি বলেন, আমি আমার মেয়েকে ২০১৬ সালের ১ জুলাই হারিয়েছি। কিভাবে গেছে, কোন ঘটনাতে গেছে, সেটা না আসাই ভালো। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার সন্তান, আরেকজনের সন্তান এখানে ২২টি পরিবারের কেউ না কেউ গেছে। যারা চলে গেছে তাদেরকে আসলে সেভাবে সম্মানটা দিয়ে সেখানেই রেখে দেওয়া উচিত। আজকে এতো বছর পর একটি সিনেমা রিলিজ হতে যাচ্ছে, তাও আবার ভারতীয় সিনেমা। যে দেশে ছবিটি হয়েছে, সেদেশে ঘটনাটি ঘটেনি। ঘটেছে আমাদের এই বাংলাদেশে।
অবিন্তার মা আরও বলেন, ২০১৯ সালের শেষের দিকে আমি জানতে পারি হলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়ে একটি সিনেমা হচ্ছে। তখন থেকে চেষ্টা করেছি বিভিন্নভাবে উকিল নোটিশ দিয়ে সিনেমাটির কার্যক্রম থামানোর জন্য। ২০২০ সালে যখন করোনা শুরু হলো সে সময় পুরো দুনিয়া অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। আমার ধারণা ছিল, সেই সিনেমাটির নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। নিজেকে নিজেই বুঝানোর চেষ্টা করেছি, ভালোই হলো। করোনার কারণে সিনেমার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ২০২১ সালের ৫ আগস্ট এই সিনেমার পোস্টার পাই। তখন বুঝেছি নির্মাণ কাজ আসলে বন্ধ হয়নি। তখন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত মুভিটি বন্ধ করার জন্য দিল্লি হাইকোর্টে মুভ করেছি। এখনও আমার মামলার কার্যক্রম চলছে। যারা সিনেমাটি বানিয়েছেন তারা ভারতের নামিদামি প্রযোজক, পরিচালক। তাদের সঙ্গে আমি ফাইট করে যাচ্ছি।
অবিন্তার মা বলেন, সিনেমাটির নাম ফারাজ হয়েছে। তার মানে ডেফিনিটলি একটি ক্যারেক্টারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সেই ক্যারেক্টারকে জোর দিতে গিয়ে আমার মেয়ের কথা চলে এসেছে। আমরা জানি না সেদিন আমার সন্তান এবং অন্যরা কিসের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। কেউ আমরা জানি না। কোনদিন আমরা জানতেও পারবো না। সে কারণে আমরা একটি গল্প বানালাম সেই গল্প বানিয়ে মুভিটা তৈরি করলাম। কিন্তু এই মুভির সঙ্গে যে পরিবারগুলো আছে তাদের কাছ থেকে তো কনসেন্ট নিতে হবে। আমাদের কাছ থেকে তো কোন কনসেন্ট নেওয়া হলো না।
তিনি বলেন, আমি কোর্টে যাওয়ার পর বলেছিলাম, আমাকে প্রি স্ক্রিনিংয়ের সুযোগ দেওয়ার জন্য। তখন আমাকে জানানো হয়েছিল এই সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু পরে আর দেওয়া হয়নি। ক্যারেক্টার এজেম্বলেশন আছে কিনা জানতে চাইলে তারা জানালো নেই। আমার মেয়ের নাম ব্যবহার করা হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হলে তখন বললো, করা হয়নি। সবই যদি ব্যবহার করা না হয়ে থাকে তাহলে মুভিটার মধ্যে কী আছে?
রুবা আহমেদ বলেন, হানসাল মেহেতার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমার প্রশ্ন ছিল তুমি আমার দেশের মানুষকে কিভাবে জানো? তুমি তো বাঙালি না। অন্য দেশের মানুষ হয়ে তুমি তো আমার দেশের মানুষকে জাজ করতে পারো না। তিনি অপমান বোধ করেছেন করে থাকলেও আমার তখন আর করার কিছু ছিল না এ কথা বলা ছাড়া।
তিনি বলেন, ভারতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন দেশেও নানা ঘটনা ঘটে। সবকিছু বাদ দিয়ে বাংলাদেশের এই ঘটনাকে নিয়ে মুভি করার জন্য এত ইন্টারেস্ট কেন? মুভিটার নাম ফারাজ কেন হবে? কেন আমাকে প্রি স্ক্রিনিং করতে দেওয়া হলো না, যদি আমার মেয়েকে নাই রাখা হয়! নিশ্চয়ই আমার মেয়েকে রাখা হয়েছে। অবিন্তার চরিত্রটি হয়েছে আয়েশা। এমনকি আমাকে উপস্থাপন করা হয়েছে মুভিতে। আমি হয়েছি রাবেয়া। শুধু তাই নয় আমার মেয়ের ছবিও দেখানো হয়েছে। তাহলে আমার মেয়ের প্রাইভেসিই বা কোথায় থাকলো? আর আমার প্রাইভেসিই বা কোথায় থাকলো।
তিনি বলেন, আমি তো এখনো বেঁচে আছি, মরে যাইনি। আমারও প্রাইভেসি থাকা দরকার, সেটাও তো নেই। আমার মেয়ের তখন বয়স ছিল ১৯ বছর। এই মুভিটা কি আমার মেয়েকে নিয়ে আসবে? ফারাজকে নিয়ে আসবে? নাকি আরও ২০টি মানুষকে নিয়ে আসবে। যারা চলে গেছে তারা তো আর ফেরত আসবে না। যে ঘটনাকে বলা হয়েছে যে, আমার মেয়ের জন্য আরেকজন মানুষ তার জীবন দিয়ে দিয়েছে সে-ই হিরো। নো নো। দ্যাটস রং। আমি এটা বিশ্বাস করি না। কারণ তার কোনো প্রমাণ নেই। সেখান থেকে কেউ বেঁচে ফিরে আসেনি। যারা বেঁচে এসেছে তারা কেউ কোনো কিছু বলতে পারে না। যদি কেউ হিরো হয়ে থাকে যে ২২টি মানুষ চলে গেছে তারাই হিরো। আমরা যারা বেঁচে আছি, নিঃশ্বাস নিচ্ছি আমরা কেউ না। ২২টি মানুষের ওপর সেদিন কী গেয়েছে আমরা কেউ বলতে পারবো না। ফারাজের ঘটনা নিয়ে যে মুভি তার তথ্য ভুল। আমার মেয়েকে ব্যবহার করা হয়েছে দিস ইস রং। অ্যাজ আ মাদার, আমি এটা কোনদিনই একসেপ্ট করতে পারি না।
তিনি বলেন, মামলাটি এখনো দিল্লি হাইকোর্টে চলছে। হাইকোর্টে আমি আপিল করেছি। দরকার হলে সুপ্রিম কোর্টে যাবো। ৩ ফেব্রুয়ারি মুভিটি রিলিজ পাবে। এটা জানি যে, আমি কিছু করতে পারবো না। ছয় মাস মুভিটির বিষয়ে আমার ইনজাংশান ছিল। তা নাহলে এটা আরো ছয় মাস আগে রিলিজ পেতো। ছয়টা মাস শুধু আটকে রাখতে পেরেছিলাম। এতটুকুনই করতে পেরেছি এখন পর্যন্ত। বাকিটা পারিনি কারণ আইনের ভাষায় পাবলিক ডোমেইনে কিছু থাকলে কিছু করার থাকে না।
বাংলাদেশের একজন অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবুর লেখা বই থেকে সিনেমাটি বানানো হয়েছে। এ বিষয়টি জানতে চাইলে রুপা আহমেদ জানান, তিনি এটি শুনেননি। প্রশ্ন রাখেন, হামলার সময় নুরুজ্জামান লাবু কি সেখানে ছিলেন? তিনি কি হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী? একটি মর্মান্তিক হামলার তথ্য লিখতে হলে নিহতের পরিবারের কাছে প্রশ্ন করতে হবে। যিনি বইটি লিখেছেন তিনি আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি। রুবা আহমেদ বলেন, আমি জাপানি দূতাবাস, ইতালি দূতাবাস এমনকি ভারতীয় হাইকমিশনে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু কেউ তাদের আসল ঘটনা জানাতে আসেনি। তাহলে প্রকৃত সত্য ছাড়াই মানুষ সিনেমা কিভাবে বানাবে?