এম নজরুল ইসলাম: রাজনীতির মাঠে এক সপ্তাহ ধরে বিএনপির তেমন কোনো আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ কেন চুপসে গেল তারা? বিভাগীয় সমাবেশের নামে গত কয়েক মাস বেশ মাঠ গরম করে রাখে বিএনপি। এত দিন ঘরে বসে থাকা নেতাকর্মীরা বাইরে আসার সুযোগ পেয়ে যান। গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গোলাপবাগ মাঠে শেষ বিভাগীয় সমাবেশটি করে তারা। এর আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল সেদিন থেকে নতুন এক বাংলাদেশ দেখতে পাওয়া যাবে। অন্তত দলের কিছু নেতা এ ধরনের মাঠ গরম করা কথাবার্তা বলে বেশ জমিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁদের আবার ঘরে ঢুকে যেতে সময় লাগেনি। ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশ থেকে ১০ দফা ঘোষণা করে বিএনপি। এর ৯ দিন পর ঘোষণা করে ২৭ দফা। তারপর হঠাৎই চুপসে যায় দলটি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল ক্ষণকালের ছন্দ।/উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল সেই তারি আনন্দ।’ বিএনপির ক্ষেত্রেও কি তেমন কিছু ঘটেছে? একটু বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বিএনপি আসলে একটি সুযোগ নেওয়ার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু সুযোগটি তাদের হাতের কাছে আসেনি। বরং যেসব দিনের অপেক্ষায় বিএনপি ছিল, তেমন দিন সহসা যে তাদের দেখা হবে না, সেটা এখন একেবারে স্পষ্ট হয়ে গেছে। কথা হচ্ছে কোন সুযোগের অপেক্ষায় ছিল বিএনপি?
গত বুধবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ আনেন যে মার্কিন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফর নিয়ে মিথ্যাচার করেছে সরকার। সুযোগ না পেয়ে এখন অভিযোগ নিয়ে হাজির হয়েছেন তিনি। নিছকই রাজনৈতিক নিয়মরক্ষা।
একটু ব্যাখ্যায় যাওয়া যাক। সম্প্রতি ঢাকা ঘুরে গেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর নেতৃত্বে আছেন তিনি। এটা তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফর নয়। গত বছর মার্চেও তিনি ঢাকা সফরে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে। এবারের সফরটি ছিল তাঁর একক সফর। সফরের শেষ দিন রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর ডোনাল্ড লু সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। আমরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কোনো বিষয়ে সমস্যা থাকলে আমরা আলোচনা করি, পরামর্শ দিতে পারি। আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখায় বিশ্বাস করি। বাংলাদেশের মতো অংশীদারদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করি।’ ডোনাল্ড লু বাংলায় বলেন, ‘আমি এখানে এসেছি দুই দেশের বন্ধুত্বকে শক্তিশালী করতে, যখন বর্তমান বিশ্ব শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে।’
নিষেধাজ্ঞার পর মানবাধিকারের ক্ষেত্রে র্যাবের উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডোনাল্ড লু। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘র্যাবের বিষয়ে বেশ ভালো আলোচনা হয়েছে। আপনারা যদি এ সপ্তাহে প্রকাশিত হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি দেখেন, সেখানে বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে। আর আমরাও স্বীকার করি, বিচারবহির্ভূত হত্যা কমানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে।’ র্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ কমে আসা প্রসঙ্গে ডোনাল্ড লু বলেন, ‘এটি অসাধারণ কাজ। এ থেকে প্রতিফলিত হয়েছে, মানবাধিকারকে সম্মান দেখিয়েই র্যাব তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ সন্ত্রাস মোকাবেলা ও আইন প্রয়োগ করতে সক্ষম।’ ডোনাল্ড লু ঢাকার একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি আজ আমাদের অংশীদারদের (বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের) বলেছি, অন্যান্য নিষেধাজ্ঞার মতো র্যাবের নিষেধাজ্ঞার বার্ষিকীতেও আমরা র্যাবের আরো সদস্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতাম। কিন্তু আমরা তা করিনি। কারণ আমরা স্বীকার করি, সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকার ও র্যাব নিজেও অগ্রগতি করেছে।’ অগ্রগতি না থাকলে র্যাবের ওপর আরো নিষেধাজ্ঞা আসত—সাক্ষাৎকারে এ কথাও উচ্চারণ করেন তিনি।
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে (আইপিএস)’ যোগ দেবে—এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা কি না, এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল তাঁকে। জবাবে ডোনাল্ড লু বলেন, ‘আইপিএস কোনো ক্লাব নয়। এখানে যোগ দেওয়ার বিষয় নেই।’ তবে আইপিএস নিয়ে চমৎকার আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি। কালের কণ্ঠে গত ১৪ জানুয়ারি প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস)’ যাচাই-বাছাই করছে সরকার। হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলেন লবাখ সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের সময় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর সফরে আবারও বার্তা এসেছে, বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক উদ্যোগে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এখানে উল্লেখ্য, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জাপান সফরের সময় ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক ফোরাম (আইপিইএফ) সৃষ্টির ঘোষণা দেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা জিএসপি পুনর্বহাল হবে কি না এমন প্রশ্নেরও মুখোমুখি হয়েছিলেন ডোনাল্ড লু। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছি। কংগ্রেস অনুমোদন দিলে বাংলাদেশ ওই তালিকায় প্রথমেই থাকবে।’
এদিকে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র জেফ রাইডেনাওয়ার গত মঙ্গলবার বলেছেন, ‘র্যাবের বিরুদ্ধে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ায় অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করেছেন। এ ধরনের সংস্কার অব্যাহত রাখার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টার আমরা প্রশংসা করি। আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগগুলোর স্বাধীন তদন্ত করতে বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহিত করি।’
এদিকে ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরে আসার আগে ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনেশিয়েটিভের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের পডকাস্টে প্রকাশিত ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা যেমন আছে, তেমনি অনেক সাফল্যও আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের এখনো জনপ্রিয়তা আছে। এই সরকার দেশের জন্য আরো সাফল্য আনতে পারে।’ এক প্রশ্নের জবাবে কুগেলম্যান এটাও বলেছেন যে ‘আজ যা যা ঘটছে তার অনেক কিছুই বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ও ঘটেছে। আমি মনে করি, এটি স্মরণ রাখা গুরুত্বপূর্ণ।’ ‘বাংলাদেশ বিশ্বে সাফল্যের গল্প’ উল্লেখ করে কুগেলম্যান ওই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। জ্বালানি ও খাবারের দাম বেড়েছে। অনেক দেশেই এমনটি হয়েছে।’ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে কুগেলম্যান বলেন, তিনি এমনটা মনে করেন না। বাংলাদেশের অর্থনীতি কোনোভাবেই শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির কাছাকাছিও নেই।
এর আগে গত ১২ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ২০২২ সালের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অধ্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বাংলাদেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নাটকীয়ভাবে কমেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
অভাবনীয় আরেকটি ঘটনা ঘটেছে গত ১২ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার। নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ভয়েস অব দ্য সাউথ সামিট ২০২৩-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যোগদান করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জি২০ জোটের সামনে ছয়টি প্রস্তাব রেখে বলেছেন, টেকসই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং গ্লোবাল সাউথের (উন্নয়নশীল বিশ্ব) উন্নয়নের জন্য এগুলো সম্মিলিতভাবে সমাধান করা প্রয়োজন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফর, যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনকে দেওয়া উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনেশিয়েটিভের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানের সাক্ষাৎকার, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ—সব মিলিয়ে গত এক সপ্তাহে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। আর এ সব কিছুই বিএনপির চুপসে যাওয়ার অন্যতম কারণ। তারা বোধ হয় ভেবেছিল, নেতিবাচক অনেক কথাবার্তা হবে, তারা মাঘের শীতে নতুন করে মাঠ গরম করার সুযোগ পাবে। তাদের অপেক্ষার শেষ হলো নৈরাশ্যে।
একটু অর্থনীতির দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ২০২৩ সাল নিয়ে বৈশ্বিক পূর্বাভাস প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক। এতে বলা হয়েছে, বিশ্ব প্রবৃদ্ধি শ্লথ হচ্ছে, এমনকি বিপজ্জনকভাবে মন্দার কাছাকাছি। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরো জোন, এমনকি চীনের অর্থনীতির অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। বৈশ্বিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৫.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে ৬.২ শতাংশ। বাংলাদেশ জিডিপির দিক থেকে এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট—সব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ আজ একটি ইতিবাচক অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য দক্ষতার কারণে। বিরোধী দলগুলোর অপরাজনীতি ব্যর্থ প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি। তাঁর রাজনৈতিক ম্যাজিক চরম বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপান্তরিত হবে স্মার্ট বাংলাদেশে।
লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি