হীরেণ পণ্ডিতঃ বাংলাদেশের গণতন্ত্র, বাক্-স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের জন্য মায়াকান্না ও অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখে অস্থির এ দেশের জনগণ। এসব মায়াকান্না ও অকৃত্রিম ভালোবাসা উতলে ওঠে এই বলে, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নাকি শূন্যের কোঠায়! যদিও গণতন্ত্র, বাক্-স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশ ১০০ তে ১০০ পাবে এমন দাবি কেউ করে না। সমস্যা কিছু না কিছু পৃথিবীর সব দেশেই আছে। তবে আমাদের অবস্থান অনেকের চেয়ে ভালো। তবে সেসব স্বঘোষিত মোড়লদের কথা আলাদা। কিন্তু তাদের আসল উদ্দেশ্য হলো এ দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে ব্যাহত করা।
আজ বাংলাদেশের যে অদম্য যাত্রা, অসাধারণ অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতি, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু থাকা এবং পরিবেশের কারণেই সম্ভব হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটা মূল লক্ষ্যই ছিল মুক্ত বুদ্ধি এবং মুক্তচিন্তার অবাধ সুযোগ করে দেওয়া। লাঞ্ছনা এবং নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। একদিকে যেমন অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে দেশকে উদ্ধার, অন্যদিকে দেশের আপামর জনসাধারণের মতামতের ভিত্তিতেই দেশ এবং সংসদ পরিচালিত হবে- এটাই ছিল আমাদের আকাঙ্ক্ষা। যেসব বিদেশি বন্ধুরা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এখন মরিয়া হয়ে উঠেছেন, তাদের কাছে ১৯৭৫-এর পর মধ্যযুগীয় বর্বরতার মাধ্যমে যারা নির্বাচন তো দূরের কথা, গণতন্ত্রকেও হত্যা করেছিল, তাদের ব্যাপারে কোনো বক্তব্য কখনো পাওয়া যায় না। এরাই মানবাধিকারের নামে নিজেদের দেশকে খুনিদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। এর সদুত্তর তারা দেন না।
১৯৭৫ সালের পর অসহনীয় পরিস্থিতিকে সামাল দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা গণতন্ত্রের নবজাগরণের পথ উন্মোচন করেন। গণতন্ত্রের পথকে প্রশস্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর চরম দুঃসময়ে ১৯৯৬ সালে আবার সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ এদেশের মানুষকে গণতন্ত্র উপহার দেয়। এই গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা একটা বিশাল মাইলফলক হিসেবে এদেশের মানুষের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। কিন্তু আজ আমাদের যে বন্ধুরা গণতন্ত্রের জন্য উতলা হয়ে উঠেছেন, তারা যদি এই বিষয়টার ওপরও নজর দিতেন তবে তা অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো। আদর্শগতভাবে গণতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনা পৃথিবীর যেকোনো দেশে বা অঞ্চলেই হোক, আমরা তাতে সম্পৃক্ত। আলাপ-আলোচনা এবং মতবিনিময়ের কোনো বিকল্প নেই। আমাদেরও তাতে আপত্তি নেই। তবে যারা আমাদের নিজস্ব দায়িত্ব সম্পর্কে বার বার তাড়া দেন, তাদের জানা উচিত প্রত্যেক দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, স্বকীয়তা থাকে। সেটার ভিত্তিতেই তারা দেশকে পরিচালিত করবে। একাডেমিক অর্থাৎ তাত্ত্বিক আলোচনায় কোনো দেশেরই আপত্তি থাকা উচিত নয়, আমাদেরও নেই। কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম দেশের রাজনীতিতে খবরদারি বা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা গণতন্ত্র ও বন্ধুত্বের জন্য শুভ নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতি, মানবাধিকার ও নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের পরামর্শে বিরক্ত দেশের মানুষ। বিদেশি কূটনীতিকরা নিয়মনীতির মধ্যে থেকে কথা বলবেন, সেটাই প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য যে নিয়ম আছে এবং সে অনুযায়ী তারা কথা বলবেন। সব দেশ সম্পর্কেও বাংলাদেশের বক্তব্য এক। গণতন্ত্র সুরক্ষা বা অন্য কোনো অজুহাতে বাংলাদেশসহ তৃতীয় কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। তাদের মনে রাখা উচিত, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার মৌলিক নীতি লঙ্ঘন করে, এমন পদক্ষেপ মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ চায়, জেনেভা কনভেনশনে গৃহীত পদক্ষেপকে সবাই অনুসরণ করবে, সম্মান করবে। সবার মনে রাখা উচিত, আওয়ামী লীগ নির্বাচন ছাড়া কখনো অন্য কোনো পন্থায় ক্ষমতায় আসেনি। আওয়ামী লীগ সব সময় গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদাবোধ সমুন্নত রেখেছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সব সময় নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনে বিশ্বাসী।
১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন পূর্ব সময়ে কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি হতো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি আর তাতেও কূটনীতিকদের ওপর স্বাগতিক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিধান অবশ্যই স্থান পেত। ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, কূটনীতিকরা স্বাগতিক দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন এবং সে দেশের ঘরোয়া ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না। কনভেনশনে ‘জুস কজেন্স’ এর স্বীকৃতি রয়েছে, যার অর্থ ওই কনভেনশন সত্ত্বেও প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের সেসব বিধান চলবে যেগুলো ওই কনভেনশন দ্বারা খণ্ডিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ওই কনভেনশনে ১৯৭০ সালে স্বাক্ষর করলেও সে দেশের সিনেট এতে অনুমোদন দেয়নি। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ভাষ্য হচ্ছে, কনভেনশনের বিধানাবলি প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের নাক গলানো কখনো সহ্য করেনি, আর তাই ভিয়েনা কনভেনশনের বহু যুগ পূর্বে, ১৮৮৮ সালে তার দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত লর্ড সেকভিলকে ‘অবাঞ্ছিত’ (পারসোনা নন গ্রাটা) ঘোষণা করলে ব্রিটিশ সরকার লর্ড সেকভিলকে রাষ্ট্রদূতের পদ থেকেই অপসারিত করেছিল। পরবর্তী সময়েও যুক্তরাষ্ট্র বহু বিদেশি কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে তার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের দায়ে।
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সে দেশের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জেতানোর চেষ্টারত থাকার অভিযোগে ১০ জন রাশিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। সম্প্রতি দেশটি ইকুয়েডরের এবং ১৯৮০ সালে দুজন লিবিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছিল। বিভিন্ন সময়ে বহিষ্কার করেছিল আরো অনেক কূটনীতিককে। বিশ্বের অন্যান্য দেশও একই পন্থা অবলম্বন করে আসছে। ১৯৮৮ সালে সিঙ্গাপুর তার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগে মার্কিন দূতাবাসের প্রথম সচিবকে বহিষ্কার করেছিল এই বলে যে সিঙ্গাপুরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে সিঙ্গাপুরের মানুষ, যেভাবে আমেরিকার মানুষ আমেরিকার রাজনীতি নির্ধারণ করে।
২০১৬ সালে ভারত গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে একজন পাকিস্তানি কূটনীতিককে শুধু বহিষ্কারই করেনি বরং বহিষ্কারের পূর্বে তাকে গ্রেপ্তারও করেছিল। ১৯৬১ সালের কনভেনশনের ৯ অনুচ্ছেদে চুক্তিভুক্ত দেশগুলো যেকোনো বিদেশি কূটনীতিককে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণার অধিকার দিয়েছে, যে বিধান প্রয়োগ করে বাংলাদেশ পাকিস্তানের একজন উপ-হাইকমিশনারকে বহিষ্কার করেছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য। তাছাড়া আরো দুজন পাকিস্তানি কূটনীতিককে ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে বহিষ্কার করা হয়েছিল আমাদের দেশে জঙ্গি অর্থায়নের কাজে লিপ্ত থাকার কারণে। ২০২১ সালে তুরস্ক সরকার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, নিউজিল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতসহ ১০ জন রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তুরস্কে কয়েক বছর ধরে আটক ওসমান কাবালা নামক এক ব্যক্তিকে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের রায় মোতাবেক মুক্তি দেওয়ার দাবি জানানোর কারণে। এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘোষণা দেন যে তার কূটনীতিকগণ স্বাগতিক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না, সেই সঙ্গে তুরস্কও ১০ কূটনীতিককে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত পরিহার করেছিল।
প্রতিটি কনভেনশনের মতো ভিয়েনা কনভেনশনের বিধানগুলোও কনভেনশনভুক্ত দেশগুলো মানতে বাধ্য। তদুপরি প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিধানসহ, সব বিধানই সব রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক। সে অর্থে আমাদের দেশে কর্মরত কয়েকজন বিদেশি রাষ্ট্রদূত আমাদের দেশের নির্বাচন, নির্বাচনব্যবস্থা, সরকারব্যবস্থা, আইন-কানুন এবং তার প্রয়োগ নিয়ে যেসব কথা বলছেন তা নিশ্চিতভাবে ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন এবং কূটনীতি সংক্রান্ত প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের মারাত্মক বরখেলাপ। বলা বাহুল্য, আমাদের কোনো কূটনীতিক অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এমনভাবে নাক গলালে, সে দেশ অনেক আগেই আমাদের কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে কনভেনশনের ৯ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করত। কনভেনশন এবং প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন ছাড়াও জাতিসংঘ সনদের বিধানগুলো মান্য করা সব সদস্য রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য বটে, যার ২(৭) অনুচ্ছেদে বলা আছে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে সব আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে (প্রতিটি রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাই আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব) দূরে থাকতে হবে। ভিয়েনা কনভেনশনের ৩১ অনুচ্ছেদে প্রতিটি রাষ্ট্রে কূটনীতিকদের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছাড়াও দেওয়ানি এবং ফৌজদারি বিষয়ে দায়মুক্তির বিধান রয়েছে, বিধান রয়েছে কত বিশেষ সুবিধা প্রদানের।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র বাংলাদেশের মানুষই চালাবে, কারো খবরদারিতে চলবে না বাংলাদেশের গণতন্ত্র। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে কোনো বাধা নেই। যেকোনো দেশ থেকেই আসতে পারে পর্যবেক্ষক। বাংলাদেশের এ ব্যাপারে কাউকে কোনো বাধা দেয়নি, ভবিষ্যতে দেবেও না।
আগামীতে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশীদারত্বমূলক নির্বাচন হবে জানিয়ে সরকার দাবি করছে নির্বাচনকালীন সরকার শুধু রুটিন মাফিক দায়িত্ব পালন করবে। ক্ষমতায় আসতে চাইলে নির্বাচনে আসার বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল। দেশের ভালো সব অর্জন আওয়ামী লীগের হাত ধরে এসেছে। তাই গণতন্ত্রের বিষয়ে এ দেশের মানুষই সিদ্ধান্তÍ নেবেন দেশ কীভাবে চলবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক