প্রশান্তি ডেক্স॥ দেশে ডলার সংকট, পণ্য আমদানিতে বাধা, ঋণপত্র খুলতে না পারা— ইত্যাদি কারণে দেশে যতগুলো খাত সরাসরি প্রভাবিত হয়েছে, তারমধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাত অন্যতম। এই খাতের মোবাইলফোন ও ল্যাপটপ পণ্যের বাজার অস্থির এবং বেহাল। দাম বেড়ে যাওয়ায় এ দুটি পণ্যে ক্রেতা একেবারে নেই বললেই চলে। এছাড়া এই দুটি পণ্য আমদানিতে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ করায় এমনিতেই দাম বেড়ে গিয়েছিল। বর্তমানে অন্যান্য সংকট যুক্ত হওয়ায় তা সাধারণের ধরা ছোঁয়ার নাগালের বাইরে চলে গেছে।

দেশের দুটি মোবাইল ফোনের কারখানায় মোবাইল সেট উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া, অন্যদের উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া, বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে মোবাইল বিক্রিতে ধস নেমেছে। অপরদিকে আমদানি কম হওয়া, ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ, গ্রে মার্কেট বড় হয়ে যাওয়া এবং পুরনো ল্যাপটপের বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে ল্যাপটেপের। কিন্তু সেই হারে বাজারে বিক্রি নেই।
যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। অনেক আইটি প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। এভাবে আরও ৬ মাস চললে অনেক তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠানগুলো লাভ তো দূরে থাক, পরিচালন ব্যয়ই তুলতে পারছে না বলে একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন। জানা যায়, মোবাইল ফোনের বিক্রি কমে যাওয়ায় একাধিক চেইন শপ বন্ধ হয়ে গেছে। উদ্যোক্তারা বলেছেন, বিক্রি কমে যাওয়ায় এমনিতেই আমরা চাপের মধ্যে আছি। এরইমধ্যে অনেক বাড়িওয়ালা দোকান ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। এই দুটোর মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যেসব বাড়িওয়ালা ভাড়া কমাচ্ছেন না, সেসব জায়গায় আমরা শপ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। কতভাবে আর লস দেওয়া যায়, প্রশ্ন করেন তারা।
বিটিআরসি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে দেশে মোট মোবাইল ফোন তৈরি হয়েছে ১৭ লাখ ৫৩ হাজার। এরমধ্যে টুজি তথা ফিচার ফোন ১৪ লাখ ৩২ হাজার, আর ফোরজি ফোন তথা স্মার্টফোনের সংখ্যা ৩ লাখ ২১ হাজার। শতাংশের হিসাবে ফিচার ফোন ৮১ দশমিক ৭০ এবং স্মার্টফোন ১৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। এই সময়ে দেশে স্মার্টফোন আমদানি হয়েছে মাত্র ২৭৭টি (ফাইভজি ফোন)। কোনও ফিচার ফোন আমদানি করা হয়নি। আরেক হিসাবে দেখা গেছে, নভেম্বর মাসে দেশে সব মিলিয়ে ফোন তৈরি হয়েছে ১৭ লাখ ২১ হাজার।
দেশের প্রযুক্তি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এন্ট্রি লেভেল বা সবচেয়ে কম দামের ল্যাপটপ পাওয়া যাচ্ছে ৩৬ হাজার ৫০০ টাকায়। যা কিছুদিন আগেও ছিল ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে। ৪০ হাজার টাকা দামের ল্যাপটপ কিনতে বর্তমানে গুণতে হচ্ছে ৫০ হাজার টাকার বেশি।
একটি নামকরা ল্যাপটপ ব্র্যান্ডের শীর্ষ কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, এখন মাঝারি মানের ল্যাপটপ বিক্রি হচ্ছে বাজারে বেশি। কারণ, এই সময়ে একেবারে প্রয়োজন না হলে কেউ ল্যাপটপ কিনছেন না। ফলে যাদের প্রয়োজন তারা মাঝারি মানের ল্যাপটপ কিনছেন। সেটার পরিমাণও একদম কম। তিনি জানালেন, সরকারি কেনাকাটা বন্ধ থাকা, খুচরা বিক্রি প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হওয়ায় বাজার বেহাল। ফলে বিক্রি একদম পড়ে গেছে। করপোরেট পর্যায়ে কিছু ল্যাপটপ বিক্রি হচ্ছে বলে আমরা এখনও টিকে আছি।
ইউনাইটেড কম্পিউটার সেন্টারের (ইউসিসি) প্রধান নির্বাহী সারোয়ার মাহমুদ খান জানালেন, তাদের নতুন ল্যাপটপের আমদানি প্রায় বন্ধ। স্টকে কিছু ছিল। সেগুলো দিয়েই তারা কাজ চালাচ্ছেন।
নাম ও পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একজন কম্পিউটার ব্যবসায়ী বললেন, বর্তমানে প্রতি মাসে ল্যাপটপ বিক্রি হয় সব ব্র্যান্ড মিলিয়ে ১০ থেকে ১২ হাজারের মতো। যা সুসময়ে ছিল ২৫-৩০ হাজার। তিনি বলেন, গত বাজেটে ল্যাপটপ আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের ফলে এর দাম বেড়ে যায়। তখন থেকেই বাজার পতনের শুরু। এই নিম্নগতি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে ডলার সংকট, ঋণপত্র খুলতে না পারা ইত্যাদি কারণে। তিনি বলেন, এই সময়ে দেশে লাগেজে করে ল্যাপটপ আনার পরিমাণ বেড়ে গেছে। তিনি জানান, গ্রে মার্কেটে মাসে ৬ থেকে ৭ হাজার ল্যাপটপ বিক্রি হচ্ছে। যারা আনছে তারা সরকারকে ট্যাক্স ভ্যাট দিচ্ছে না, ফলে তাদের খরচ হচ্ছে না। এছাড়া দেশে ঢুকছে আমদানি নিষিদ্ধ পুরনো ল্যাপটপ। রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোড ও মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের দুটি মার্কেটে পুরনো ল্যাপটপের ব্যবসা জমজমাট বলে জানা গেছে।
দেশের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি পণ্যের প্রতিষ্ঠান স্মার্ট টেকনোলজিসের পরিচালক (চ্যানেল সেলস) মুজাহিদ আল বেরুনি সুজন বলেন, ‘বাজারে ল্যাপটপের যে চাহিদা, সে অনুযায়ী দিতে পারছি না। সব ব্র্যান্ডেরই কিছু কিছু ল্যাপটপ আসছে। সামগ্রিক কারণে দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে বিক্রির পরিমাণ কম।’ ব্যক্তিগত কম্পিউটার ((পিসি) বিক্রির চিত্রও একই বলে তিনি জানান। তিনি আরও জানান, অন্যান্য প্রযুক্তি পণ্য বিক্রি হচ্ছে অল্প স্বল্প। কিন্তু ল্যাপটপের কারণে সবকিছুর বিক্রিতে প্রভাব পড়েছে।
জানা যায়, বৈধ পথে ল্যাপটপ আমদানি করলে প্রতি ল্যাটপটের জন্য সরকারকে দিতে হচ্ছে ৩২ শতাংশ ট্যাক্স ও ভ্যাট। এরমধ্যে আছে অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি) ৫ শতাংশ, সিডি (কাস্টম ডিউটি) ৫ শতাংশ, এটিভি (অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাট)৫ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ এবং ব্যাক ক্যালকুলেশন ২ শতাংশ। ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের আগে যা ছিল ১৭ শতাংশ। এই কারণে ল্যাপটপের দাম বেড়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।