‘বাংলা’ অন্য ভাষার অধিকারের প্রতীক

প্রশান্তি ডেক্স॥ বুকের রক্ত দিয়ে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বিশ্বে এক বিরল ঘটনা। সেই রক্ত শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেনি, বিশ্বের কাছে নতুনভাবে পরিচিত করিয়েছে বাংলা ভাষাকে। বাংলা ভাষা এখন শুধু মুখে বলার ভাষা কিংবা লেখার ভাষা নয়, তা রূপ নিয়েছে এক আন্তর্জাতিক প্রতীকে। এই প্রতীক ভাষার অধিকারের প্রতীক। আর তাই এখন ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।     

বাংলা প্রদেশের বা বাঙালির মাতৃভাষা তো বাংলাই হবে— এ চেতনার পটভূমি রচিত হয়েছিল ভারত ভাগের আগেই। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পূর্ববাংলায় শাসকবিরোধী তীব্র মনোভাবের মাঝেই বাংলা ভাষার জন্য জ্বলে ওঠে স্ফূলিঙ্গ। ভাষা সৈনিকরা তাদের লেখনিতে একইভাবে জানিয়েছেন— মহান একুশে ফেব্রুয়ারির সূচনার কথা। ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই। আর তাই একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবসে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ বাঙালির অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। জাতিসংঘের ঘোষণায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এ দিবস ‘১৯৫২ সালের একুশে ফ্রেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের মানুষের অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের স্বীকৃতি’।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়েছিল। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি হয়েছিল। ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্র-জনতা গর্জে ওঠে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। মিছিলে চালানো হয়েছিল অতর্কিত গুলি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছেই গুলিবর্ষণ হয়েছিল শিক্ষার্থীদের ওপর।

ভাষা আন্দোলনে ঠিক কতজন শহীদ হয়েছিলেন সেবিষয়ে সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে সেদিন ও পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং শফিউর ছাড়াও আরও অনেকে শহীদ হয়েছিলেন বলে ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ে উঠে এসেছে। এই ঘটনার পর দুই বছরেরও বেশি সময় পরে, ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান পার্লামেন্টে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি কার্যকর হতে লেগেছিল আরও দুই বছর।

ভাষার প্রতি বাঙালিদের এই যে ভালোবাসা, সাহস ও আত্মত্যাগ— মূলত একারণেই শুধু বাংলাদেশই নয়, সারাবিশ্বে বাংলা এখন সুপরিচিত ভাষা। ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করার পর থেকে মহান ভাষা আন্দোলনের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে বিশ্বের। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, লাটভিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ পৃথিবীর নানা স্থানে ভাষার দাবিতে সংগ্রাম হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে নানা সময় বিভিন্ন রাজ্যে ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি উঠেছে। তবে বাঙালির মতো ফলপ্রসূ আন্দোলন কেউ করতে পারেনি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।  

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ বলেন, ‘ভাষার অধিকারের জন্য বাঙালিরা রক্ত দিলেন। এদেশে শহীদ দিবস প্রতিষ্ঠিত হলো। তার পরিপ্রেক্ষিতে একটা স্বাধীন দেশ পেলাম আমরা। আমাদের জীবনের সর্বস্তরে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো। এরপর ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যার ফলে অধিকার রক্ষার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় বাংলা ভাষা।’    

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও ভাষাবিদ অধ্যাপক ড. শিশির ভট্টাচার্য বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশেই হয়েছে আন্দোলন। কিন্তু এরকম ফলপ্রসূ আন্দোলন কোথাও হয়নি। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় শহীদ হয়েছেন অনেকেই, তাদের আত্মত্যাগের কারণে বাংলা তো দাফতরিক ভাষা হয়েছে এবং তাদের স্মরণে শহীদ মিনার তৈরি হয়েছে। এরপর এটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হলো। মাতৃভাষার যে একটা দিবস হলো, কিংবা এখানে মাতৃভাষার অধিকারের যে বিষয় আছে, সেটি কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো। এই কারণেই কিন্তু আমাদের মাতৃভাষার আন্দোলন সারা পৃথিবীর মাতৃভাষার আন্দোলন হয়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আসলে মাতৃভাষার জন্য কিন্তু আন্দোলন ছিল না। আন্দোলন ছিল মাতৃভাষার স্বীকৃতির আন্দোলন। অর্থাৎ মাতৃভাষাকে দাফতরিক ভাষার স্বীকৃতির আন্দোলন। ভাষার সঙ্গে উন্নয়নের একটা সম্পর্ক আছে, সেটি কিন্তু বাঙালিরা পৃথিবীর বুকে প্রথম তুলে ধরেছে। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি দেশের জন্ম হয়েছে। এরকম ঘটনা বিশ্বে আর হয়নি।’  

Leave a Reply

Your email address will not be published.