বিশ্ব শ্রবণ দিবসে উচ্চারণ – ‘শব্দ দূষণে ঢাকার বাসিন্দারা কানে কম শুনবেন ’

প্রশান্তি ডেক্স\ বিশ্ব শব্দদূষণ দিবসে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হলো আগামীর সতর্কতা। অতিরিক্ত শব্দে কানের ভেতরের বিশেষ এক ধরনের কোষ ধ্বংস হয়ে যায়। এতে স্থায়ীভাবে শ্রবণের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকায় শব্দের যে মাত্রা তাতে অধিকাংশ মানুষ দীর্ঘদিন রাজধানীতে বসবাস করলে ধীরে ধীরে কানে কম শুনতে পারেন বলে চিকিৎসকরা সতর্ক করছেন।

রাজধানী ঢাকার সব এলাকাতেই শব্দের মাত্রা এখন অনেক বেশি। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-তে উল্লেখিত আদর্শমান অতিক্রম করেছে প্রায় সব জায়গাতেই। নগরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণভাবে শব্দের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রা পরীক্ষা করে দেখা যায়, প্রায় ১.৩ থেকে ২ গুণ বেশি শব্দ হচ্ছে। দূষণ রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এমন পরিস্থিতিতে দেশে গত (৩ মার্চ) পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব শ্রবণ দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উদ্যোগে ২০০৭ সালের এই দিনে প্রথমবারের মতো পালিত হয় বিশ্ব শ্রবণ দিবস। প্রতিবছরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি নতুন ে¯্লাগান ঘোষণা করে। ২০২৩ সালের ে¯্লাগান হলো ‘সকলের জন্য কান ও শুনানির যত্ন। বিভিন্ন হাসপাতাল এবং কয়েকটি সংস্থা নানা আয়োজনে পালন করে দিবসটি।

শব্দদূষণ

স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়, ঢাকা শহরে আশঙ্কাজনকভাবে শব্দদূষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। গবেষণায় দেখা যায়, রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই শব্দের মাত্রা শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-তে উল্লেখিত আদর্শমান অতিক্রম করেছে। নগরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণভাবে শব্দের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রার থেকে প্রায় ১.৩ থেকে ২ গুণ বেশি শব্দ পাওয়া যায়। এরমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ৭৬.৮০ ডেসিবেল। সবচেয়ে বেশি নিউ মার্কেট মোড়, নয়া পল্টন মোড় এবং প্রেসক্লাব মোড়ে, এসব জায়গায় শব্দদূষণের মাত্রা যথাক্রমে ১০০.৬৫ ডেসিবেল, ৯২.২২ ডেসিবেল এবং ৯০.০৩ ডেসিবেল। আর সবচেয়ে কম দূষণ ছিল আবুল হোটেল মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়, এবং জিরো পয়েন্ট মোড়ে। সেখানে শব্দদূষণের মাত্রা যথাক্রমে ৭৮.২৭ ডেসিবেল, ৭৭.৯২ ডেসিবেল এবং ৭৭.৬০ ডেসিবেল।

এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ৮০.৫৬ ডেসিবেল, যা দক্ষিণের চেয়ে বেশি। সবচেয়ে বেশি শব্দ পাওয়া গেছে মোহাম্মদ বাসস্ট্যান্ড মোড়, শিয়া মসজিদ মোড় ও মাসকট প্লাজা মোড়ে, সেখানে শব্দদূষণের মাত্রা যথাক্রমে ৯৯.৭৭ ডেসিবেল, ৯৩.০৫ ডেসিবেল ও ৯০.২৭ ডেসিবেল। আর সবচেয়ে কম মিরপুর বেড়িবাঁধ মোড়, রবীন্দ্রসরণি মোড় ও গুলশান-২ মোড়ে, সেখানে শব্দদূষণের মাত্রা যথাক্রমে ৭৪.৮৬ ডেসিবেল, ৭৫.২৫ ডেসিবেল এবং ৭৬.০১ ডেসিবেল।

প্রসঙ্গত, শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী ঢাকার জন্য দিনের বেলায় শব্দের আদর্শমান (সর্বোচ্চ সীমা) ৬০ ডেসিবেল। সেক্ষেত্রে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের তীব্রতা মানমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

ঢাকা শহরে শব্দদূষণের উৎস : সিটি করপোরেশন এলাকাগুলোতে যানবাহনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ায় শব্দদূষণের মাত্রাও বাড়ছে। শহর এলাকায় শব্দদূষণের প্রভাব গ্রামাঞ্চল থেকে তুলনামূলক অনেক বেশি। সাধারণত যানবাহন চলাচলের শব্দ (হর্ন, ইঞ্জিন, চাকার ঘর্ষণ ও কম্পনের শব্দ), রেলগাড়ি চলাচলের শব্দ, বিমান উঠানামার শব্দ, নির্মাণকাজ যেমন- ইট ও পাথর ভাঙার মেশিন ও টাইলস কাটার মেশিনের শব্দ, ভবন ভাঙার শব্দ, কলকারখানার শব্দ, জেনারেটরের শব্দ, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের মাইকিংসহ ইত্যাদি উৎস হতে শব্দ উৎপন্ন হয়। শুধু ঘরের বাইরে, রাস্তায়, কর্মস্থলে নয়, শব্দদূষণ ঘরে থাকা যন্ত্রপাতি, যেমন- ফুড রেন্ডার, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ও প্রেসার কুকারের মাধ্যমেও হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে এখন হাইড্রোলিক হর্ন। সাধারণ হর্নের সঙ্গে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় শব্দদূষণের মাত্রা অনেক বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন : এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, আইন ঠিকই আছে, কিছু অভিযানও চলছে। কিন্তু সে অভিযান পর্যাপ্ত নয়। শব্দদূষণ বন্ধ করতে হলে সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপ একসঙ্গে নিতে হবে। আইন আছে, কিন্তু আইনের কঠোর প্রয়োগ নেই। সব মিলিয়ে সরকারের সদিচ্ছার অভাব বলেই তিনি মনে করেন।

এ বিষয়ে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, শব্দদূষণ রোধ করতে হলে ঢাকা শহরকে হর্নমুক্ত ঘোষণা করতে হবে। তিনি বলেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত হাইড্রোলিক হনের্র ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেই সাথে যাত্রী, চালক ও গাড়ির মালিকদের সচেতনতা নিশ্চিত করতে হবে। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী, চিহ্নিত এলাকাগুলোতে (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) সাইনপোস্ট উপস্থাপন করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন তিনি। পাশাপাশি কঠোর মনিটরিং করতে হবে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি নিতে হবে সচেতনতামূলক প্রচারণাও।

মানুষের কানের সহনীয় শব্দমাত্রা সাধারণত ৫৫ থেকে ৬০ ডেসিবেল। কিন্তু টানা এই মাত্রা ৮৫ ডেসিবেলের বেশি হলে শ্রবণশক্তির ক্ষতি হতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসকদের মতে, আমাদের দেশের প্রায় ৯ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ যেকোনও মাত্রার বধিরতায় ভুগে থাকেন। শব্দদূষণজনিত বেশ কিছু কাজ আমরা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি, সেগুলোর কিছু দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। ফলে আমাদের অন্তঃকর্ণের বিশেষ একধরনের কোষ ধ্বংস হয়ে স্থায়ীভাবে শ্রবণের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কী বলছেন চিকিৎসকরা : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অটোলারিঙ্গোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত জোয়ার্দার বলেন, বাংলাদেশে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ কোনও না কোনও মাত্রার বধিরতায় ভুগছেন। একটি নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে চলে গেলে আমরা সেটিকে হেয়ারিং লস বলি। কিছু মৃদু বধিরতা আছে, অল্প পরিমাণে শুনতে কষ্ট হয় কিছু মানুষের। বধিরতার কারণ দুইভাবে হতে পারে, একটি জন্মগত আরেকটি জন্মের পর। জন্মের আগে একরকম হতে পারে, জন্মের পর আরেক রকম।

তিনি আরও বলেন, জন্মের আগে যেসব হয় রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়ের সঙ্গে যদি বিয়ে হয় তাহলে হতে পারে। কাজিন ম্যারেইজ যেগুলো হয় সেখানে মারাত্মক ধরনের বধিরতা দেখা যায়। এরপর যেটি মারাত্মক আকার ধারণ করছে সেটি হচ্ছে তীব্র শব্দের কারণে। নগরায়ণের সঙ্গে শব্দদূষণ বাড়ছে, যার কারণে বধিরতা বাড়ছে। এগুলো সচেতনতা তৈরি এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিলে কমানো সম্ভব। এছাড়া কিছু ওষুধের কারণেও এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়।

তিনি বলেন, শব্দদূষণ দুভাবে আমাদের কানে প্রভাব ফেলছে। শব্দদূষণ সরাসরি বধিরতা সৃষ্টি করে, কানে শোনার ক্ষমতা ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয়। প্রথমে হয়তো দেখা যায় কনসার্টের মতো জায়গায় গেলে সমস্যা দেখা দেয়, আবার বিশ্রাম দিলে ঠিক হয়ে যায়। এরকম দুই-একবার হলে আর ভালো হয় না। আবার সড়কের পাশে যারা কাজ করেন যেমন, ট্রাফিক পুলিশ, রিকশাচালক তাদের ক্ষেত্রে শব্দদূষণের প্রভাব মারাত্মক। এদের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে বধিরতা বাড়ছে। উচ্চমাত্রার শব্দের মধ্যে কয়েক বছর ধরে কাজ করলে তার মধ্যে বধিরতা দেখা দেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.