ঢামেক ও শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে স্বজনহারাদের মাতম

প্রশান্তি ডেক্স ॥ রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে ক্যাফে কুইন ভবনে বিস্ফোরণে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের স্বজনদের আহাজারি থামছে না। স্বজনদের শোকে ভারী হয়ে আছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড সার্জারি ইউনিটের পরিবেশ। হাসপাতালে দুদিন ধরে অপেক্ষারত স্বজনদের কারও চোখে জল, কারও বোবা কান্না, কেউ আছেন অপলক তাকিয়ে।

আহত ও দগ্ধ ব্যক্তিদের বাবা-মা ও ভাই-বোনরা হাসপাতালে দিগবিদিক ছোটাছুটি করছেন। এদিকে মর্গের সামনে এখনও অপেক্ষারত নিহত ব্যক্তিদের স্বজনরা।

গত বৃহস্পতিবার (৯ মার্চ) বিকালে সরেজমিনে ঢামেক ও বার্ন ইউনিটে গেলে এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্যের দেখা মেলে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের বজরা বাজার এলাকার মেহেদী হাসান স্বপন ২০ বছরে ধরে সিদ্দিকবাজারের ওই ভবনে ‘বাংলা স্যানেটারি’ নামের দোকানে কাজ করেন। স্ত্রী-সন্তান গ্রামের বাড়িতে থাকেন। দোকানের সহকর্মীদের সঙ্গে পশ্চিম রামপুরায় বসবাস করে আসছেন। ওই দোকানের ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

গত মঙ্গলবার বিকালে বিস্ফোরণের সময় দোকানেই ছিলেন স্বপন। হিসাব-নিকাশ শেষে দোকান থেকে বের হবেন, এমন সময় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এরপর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি। ঘটনার দুদিন পর আজ সকালে মার্কেটের বেজমেন্ট থেকে স্বপনের মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।

বিকালে স্বপনের মরদেহ বুঝে নিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গের সামনে অপেক্ষা করছিলেন স্বজনরা। সেখানে নিহত স্বপনের বড় বোন মাকসুদা লিপি, ভাই তানভির হাসান ও ভাগনে মাহফুজ শোকে কাতর হয়ে আছেন। স্বপনের বড় ভাই তানভির হাসান বাকরুদ্ধ। জানতে চাইলে নিজেকে কিছুটা সামলে কথা বলার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, আমার ভাই অর্ধেক জীবন কাটিয়ে দিয়েছে সিদ্দিকবাজারে। এমন দুর্ঘটনায় ভাইয়ের মৃত্যু হলো। আমরা এমন শোক সহ্য করবো কী করে? স্বপনের ছোট্ট দুটি ছেলে-মেয়ে আছে। তারা তাদের বাবাকে খুঁজবে। বাচ্চাদের কাছে এখন আমরা কী উত্তর দেবো বলেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন তানভির।

চট্টগ্রামের পল্লব চক্রবর্তী বিভিন্ন গিফট সামগ্রীর ব্যবসা করেন রাজধানীর ফকিরাপুলে। ঘটনার দিন সিদ্দিকবাজারের ক্যাফে কুইন ভবনের পাশের ভবনের সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে অর্ডারের মাল বুকিং দিতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ ওই বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন পল্লব। ঢামেক ১০২ নম্বর ওয়ার্ডের আরবিএক্স ২ নম্বর বেডে এখন কাতরাচ্ছেন। দুর্ঘটনায় পল্লবের এক পায়ের হাড় দুই ভাগ হয়ে গেছে। সারা শরীরে দেখা গেছে আঘাতের চিহ্ন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বিস্ফোরণের দুর্বিষহ মুহূর্ত নিয়ে পল্লব বর্ণনা দেন প্রতিবেদকের কাছে।

পল্লব বলেন, যেখানে বিস্ফোরণ হয়েছে, এর পাশের একটি ভবনে ছিলাম আমি। একটা বিকট শব্দে সারা মার্কেট সেকেন্ডের মধ্যে অন্ধকার হয়ে যায়। আমার শরীরে ভারী ভারী জিনিসপত্র বৃষ্টির মতো এসে লাগতে থাকে। তারপর আর কিছুই মনে নেই আমার। শুনেছি স্থানীয়রা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে।

একমাত্র ছেলে জাহান সরদার সেলিমের অবস্থা দেখে হাসপাতালের মেঝেতে বসে হাউমাউ করে কাঁদছেন মা সেলিনা বেগম। বাবা জাহাঙ্গীর আলম চাপাকান্না বুকে নিয়ে একবার নিচে নামছেন আবার ওপরে উঠছেন। যেন বুঝে উঠতে পারছেন কী করবেন।

জানা গেছে, রাজধানীর নবাবগঞ্জের ডিএন কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী জাহান সরদার সেলিম। সহপাঠীদের ফোন পেয়ে যাত্রাবাড়ী থেকে কলেজে গিয়েছিলেন পরীক্ষার খোঁজ নিতে। কাজ শেষে ক্যাফে কুইন ভবনের সামনে দিয়ে ফিরছিলেন বাসায়। মুহূর্তের ওই দুর্ঘটনায় তিনিও আহত হন। বিস্ফোরণে তার শরীরের ৫০ শতাংশ দগ্ধ হয়ে তিনি ঢামেকের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন আছেন।

আহত জাহানের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার একটি মাত্র ছেলে। ভালোভাবে পড়ালেখা করার জন্য অর বোনের বাসায় যাত্রাবাড়িতে থাকতো। বন্ধুদের ফোন পেয়ে সকালে কলেজে যায়। আর আমরা তাকে হাসপাতালে এসে খুঁজে পাই। ডাক্তাররা বলছে ৫০ শতাংশ আগুনে পুড়েছে। আমার ছেলের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আমাকে আসল কথা বলেন না ডাক্তাররা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জাহাঙ্গীর বলেন, ছেলের ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশে পড়ে বিদেশে পড়তে যাওয়ার। আমার ছেলের ইচ্ছে কি পূরণ হবে? বলেই চাপা কান্না শুরু করেন তিনি।

সিদ্দিকবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ওই ভবনের কয়েকটি ভবন পরেই স্যানেটারি দোকান রয়েছে আমিনুল ইসলামের। দোকান খুলেই বের হন নামাজ আদায় করতে। নামাজ শেষে আসার পথেই ভবনের দেয়াল ভেঙে টুকরো এসে পড়ে তার শরীরে। গুরুতর আহত হয়ে তিনি এখন ঢামেকে ভর্তি। দুর্ঘটনায় তার হাত, মাথা, পিঠে প্রচন্ড আঘাত লেগেছে। হাসপাতালের ১০২ নম্বর ওয়ার্ডের ৮ নম্বর বেডের চারপাশ ঘিরে রেখেছেন স্বজনরা। আমিনুলের ভাই, বোন অস্থির হয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটি করছেন। বোন রোকশনা পাশেই বসে যত্ন নিচ্ছেন ভাইয়ের।

গত বৃহস্পতিবার (৯ মার্চ) বিস্ফোরণে আহত ও দগ্ধদের উন্নত চিকিৎসার জন্য আলাদা বোর্ড গঠন করা হয়। চার সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড সার্জারি ইউনিট ভর্তি দগ্ধদের উন্নত চিকিৎসা দিতে ২০ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, দুর্ঘটনায় আহত ১৫ রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন ঢামেক হাসপাতালে। তাদের মধ্যে একজন আইসিইউতে, বাকি ১৪ জন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আহতদের উন্নত চিকিৎসা দিতে আমরা মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেছি। চিকিৎসাধীন রোগীদের মাথাসহ শরীরে মাল্টিপল ইনজুরি রয়েছে, এখানে কয়েক বিভাগের চিকিৎসকের প্রয়োজন হয়।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. কামন্ত লাল সেন বলেন, বার্ন ইউনিটে বর্তমানে ৯ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে লাইফ সাপোর্টে আছেন তিনজন। বাকিদের কেবিনে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অবস্থা বুঝে পরবর্তী চিকিৎসা দেওয়া হবে। তাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা একটু ভালো; তবে শঙ্কামুক্ত নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.