প্রশান্তি ডেক্স ॥ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৫০ বছরপূর্তি ছিল শুক্রবার (৭ এপ্রিল)। ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ কতটা কার্যকর সংসদে পরিণত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ৫০ বছরের সংসদে সেই অর্থে সক্রিয় বিরোধী দল দেখা যায়নি। সংসদ কার্যকর করার ক্ষেত্রে সব চেয়ে ভূমিকায় যার থাকার কথা, সেই বিরোধী দলকে হয় দেখা গেছে নিষ্ক্রীয়, নয়তো সংসদ বর্জন করতে। বর্তমানে বর্জনের সংস্কৃতি বিদায় নিলেও বিরোধী দলকে কার্যকর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে তাদের কিছুটা ইমেজ সংকটও রয়েছে। তবে, অতি সম্প্রতি সংসদে অশালীন ও অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হয়েছে কথা বলার সময় মাইক বন্ধ করে দেওয়ার সংস্কৃতিও।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ৫০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রথম জাতীয় সংসদে কোনও বিরোধী দল ছিল না। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদে নামকাওয়াস্তে বিরোধী দল ছিল। এই তিনটি সংসদে বিরোধী দলকে অনেকটা কোণঠাসা দেখা গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের পর সংসদ যতটা কার্যকর হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, বাস্তবে সেটা দেখা যায়নি। এ সময় দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যারাই বিরোধী দলে থেকেছে, তারা সংসদ বর্জনটাকেই বেছে নিয়েছে। ফলে বাস্তব কারণেই সংসদ চলেছে একতরফাভাবে।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, নবম সংসদের মেয়াদে সংসদ বর্জনের রেকর্ড গড়েছিল তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। ৪১৮ কার্যদিবসের মধ্যে তারা অনুপস্থিত ছিল ৩৪২ দিন। এর আগে অষ্টম সংসদে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সদস্যরা সর্বোচ্চ ২২৩ দিন অনুপস্থিত ছিলেন। ওই সংসদ শেষ হয়েছিল ৩৭৩ কার্যদিবসে। এর আগে সপ্তম জাতীয় সংসদের ৫ বছরে মোট কার্যদিবস ছিল ৩৮২ দিন। এ সময় তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি বর্জন করে ১৬৩ দিন। সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে আসার পর প্রথম সংসদ অর্থাৎ পঞ্চম সংসদের ৫ বছরে মোট কার্যদিবস ছিল ৪০০ দিন। ওই সময় বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংসদ বর্জন করে ১৩৫ দিন।
এদিকে সবশেষ দুটি সংসদে বিরোধী দল বর্জনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এলেও বিরোধী দল হিসেবে যে ভূমিকা তাদের পালন করার কথা, সেখানটায় ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বিগত টার্মে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার নির্বাচন এবং একইসঙ্গে বিরোধী দল ও সরকারের অংশীদার হওয়ার কারণে সংসদে তারা প্রকৃত ভূমিকা পালন করতে পারেনি। জাতীয় পার্টি চলতি টার্মে সরকারের অংশীদার না হয়ে কেবল বিরোধী দল হলেও বিগত সময়ের অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফলে বিরোধী দল হিসেবে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা কম।
আইন প্রণয়ন জাতীয় সংসদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সেখানে পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের সংসদে জনস্বার্থের আলোচনার তুলনায় নিজ দলের নেতৃত্বের স্তুতিবন্দনা এবং বিরোধী নেতৃত্বের বিষোদগারই বেশি দেখা গেছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের সংসদের মোট সময়ের মাত্র ১২ শতাংশ আইন প্রণয়নে ব্যয় হয়, যা ভারতে ৩২ শতাংশ, আর যুক্তরাজ্যে ৪৮ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সামরিক শাসনের কালো অধ্যায় পেরিয়ে ১৯৯০ সালের পর থেকে ওয়ান-ইলেভেনের দুই বছর বাদে দেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে সংসদীয় রাজনীতি চালু রয়েছে। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। সংসদীয় কার্যক্রমে বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও তা বেশিরভাগ সময় পালন করতে দেখা যায়নি। ১১টি সংসদে অর্ধেকের বেশি সময় বিরোধী দল ছিল নামকাওয়াস্তে। বাকি সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখনই বিরোধী দলে ছিল, তখনই তারা সংসদ বর্জনের পথ বেছে নিয়েছে। ফলে জনগণের মনোযোগ হারিয়ে গেছে সংসদের কার্যক্রম থেকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সংসদকে এখনও কার্যকর দেখছি না। অতীতেও কার্যকর ছিল সেটাও বলতে পারছি না। অতীতে দেখেছি বিরোধী দলকে সংসদ বর্জন করতে। এখন দেখছি বিরোধী দল সরকারি দলের অনুগত। সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করা ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে দেখছি না।’
তিন জোটের রূপরেখার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘ওই সময় রূপরেখার অন্যতম শর্ত ছিল সংসদকে কার্যকর করা। এর অর্থ ওই সময় সংসদ কার্যকর ছিল, তা কিন্তু না। রূপরেখায় এ শর্ত থাকলেও পরবর্তীকালে আমরা তার প্রতিফলন দেখেছি না।’ বাংলাদেশের সংবিধান তুলনামূলকভাবে কার্যকর বলে মনে করেন ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সংসদের কাজ হচ্ছে জনগণের পক্ষে ভূমিকা পালন করা। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে আলোচনায় অংশ নেওয়া এবং আইন প্রণয়নে ভূমিকা পালন করা। সংসদে এসব কার্যক্রম ভালোভাবেই সম্পন্ন হচ্ছে। এটা আগের সংসদগুলোতেও আমরা দেখতে পেয়েছি। এখনও চলমান হয়েছে। তবে, এটাকে আরও কার্যকর হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সরকারি দল ও বিরোধী দল প্রত্যেকে তাদের দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করে এটা করতে পারেন।’
সংসদবিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে যত মেকানিজম থাকা দরকার, সবই বর্তমান সংসদে কার্যকর রয়েছে। তারপরও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। অপরদিকে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বিরোধী দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অতীতেও কার্যকর বিরোধী দল ছিল না, বর্তমানেও প্রকৃত বিরোধী দল সংসদে নেই।’
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হলো সংসদ। সরকারি দল ও বিরোধী দলের উপস্থিতির পাশাপাশি তাদের পারস্পরিক আলোচনা ও সমালোচনার মাধ্যমে সংসদ সমৃদ্ধ হয়। এতে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ ও আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলনও ঘটে। এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।’ তিনি নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আইন সভার ভূমিকা সম্পর্কে বলেন, ‘সংসদীয় কমিটিগুলো পুরোপুরি কার্যকর রয়েছে। তারা নিয়মিত বৈঠক করছে। আর জবাবদিহি একেবারেই নিশ্চিত করা যায়নি বলে যা বলা হচ্ছে, তা মোটেই সত্য নয়।’ তিনি পরপর তিন মেয়াদে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণেই রাজপথে উত্তেজনা, বিশৃঙ্খলা, গাড়ি ভাংচুর ও হরতালের বিষয়গুলো সেভাবে অনুভূত হয়নি। ফলে দেশের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। দেশ উন্নীত হয়েছে।’
এক নজরে ১১টি সংসদ : প্রথম সংসদ: নির্বাচন- ৭ই মার্চ ১৯৭৩; মেয়াদ- ৭ এপ্রিল ১৯৭৩-৬ নভেম্বর ১৯৭৫; সংখ্যাগরিষ্ঠ- দল আওয়ামী লীগ; সংসদীয় দলের নেতা- শেখ মুজিবুর রহমান; বৈঠক ১৩৪টি; প্রণীত আইন ১৫৪টি।
দ্বিতীয় সংসদ: নির্বাচন- ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯; মেয়াদ ২ এপ্রিল ১৯৭৯-২৪ মার্চ ১৯৮২; সংখ্যাগরিষ্ঠ দল- বিএনপি; নেতা- জিয়াউর রহমান; বিরোধী দল- আওয়ামী লীগ; বৈঠক ২০৬টি; প্রণীত আইন সংখ্যা ৬৫টি।
তৃতীয় সংসদ: নির্বাচন- ৭ মে ১৯৮৬; মেয়াদ- ১০ জুলাই ১৯৮৬-৬ ডিসেম্বর ১৯৮৭; সংখ্যাগরিষ্ঠ দল- জাতীয় পার্টি; নেতা- হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ; বিরোধী দল- আওয়ামী লীগ; বৈঠক ৭৫টি; প্রণীত আইন ৩৯টি।
চতুর্থ সংসদ: নির্বাচন- ৩ মার্চ ১৯৮৮; মেয়াদ- ১৫ এপ্রিল ১৯৮৮-৬ ডিসেম্বর ১৯৯০; সংখ্যাগরিষ্ঠ দল- জাতীয় পার্টি; নেতা- এইচ এম এরশাদ; বৈঠক ১৬৮টি; প্রণীত আইন ১৪২টি।
পঞ্চম সংসদ: নির্বাচন- ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১; মেয়াদ- ৫ এপ্রিল ১৯৯১-২৪ নভেম্বর ১৯৯৫; সংখ্যাগরিষ্ঠ দল- বিএনপি; নেতা- খালেদা জিয়া; বৈঠক- ৪০০টি; প্রণীত আইন- ১৭৩টি।
ষষ্ঠ সংসদ: নির্বাচন ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬; মেয়াদ- ১৯ মার্চ ১৯৯৬-৩০ মার্চ ১৯৯৬; সংখ্যাগরিষ্ঠ দল- বিএনপি; নেতা- খালেদা জিয়া; বৈঠক ৪টি; প্রণীত আইন একটি। (বাংলাদেশের ইতিহাসে সংক্ষিপ্ত সংসদ মেয়াদ ১২ দিন)।
সপ্তম সংসদ: নির্বাচন- ১২ জুন ১৯৯৬; মেয়াদ- ১৪ জুলাই ১৯৯৬-১৩ জুলাই ২০০১; সংখ্যাগরিষ্ঠ দল- আওয়ামী লীগ; নেতা- শেখ হাসিনা; বৈঠক ৩৮২টি; প্রণীত আইন ১৯১টি।
অষ্টম সংসদ: নির্বাচন ১ অক্টোবর ২০০১; মেয়াদ ২৮ অক্টোবর ২০০১-২৭ অক্টোবর ২০০৬; সংখ্যাগরিষ্ঠ দল- বিএনপি, নেতা- খালেদা জিয়া; বৈঠক ৩৭৩টি; প্রণীত আইন ১৮৫টি।
নবম সংসদ: নির্বাচন ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮; মেয়াদ ২৫, জানুয়ারি ২০০৯-২৮ ডিসেম্বর ২০১৩; সংখ্যাগরিষ্ঠ দল- আওয়ামী লীগ; নেতা- শেখ হাসিনা; বৈঠক ৪১৮টি; প্রণীত আইন ২৭১টি।
দশম সংসদ: নির্বাচন- ৫ জানুয়ারি ২০১৪; মেয়াদ ২৯ জানুয়ারি ২০১৪-২৮ জানুয়ারি ২০১৯, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ: নেতা- শেখ হাসিনা; বৈঠক ৪১০টি, প্রণীত আইন ১৯৩টি। একাদশ সংসদ: নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮; মেয়াদ ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ থেকে চলমান, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল- আওয়ামী লীগ: নেতা- শেখ হাসিনা; এ পর্যন্ত বৈঠক ১৩৩টি; প্রণীত আইন ১১৮টি।