বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে সাংবাদিক নির্যাতন: নির্যাতন, নিপীড়নের খবর প্রকাশ করলে চলতো পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন ও প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি

বাআ ॥ ২০০১ সালের নির্বাচনের আগ থেকে দেশের মানুষের ওপর ত্রাসের সঞ্চার করেছিলো বিএনপি-জামায়াত জোট। সংখ্যালঘুদের নির্যাতন, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, মা-বোনদের সম্‌ভ্রম হানি করা, সম্পত্তি দখল করা, আওয়ামী লীগ কর্মীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন সবকিছুতেই জড়িয়েছিল বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডারদের নাম। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্ররোচনায় স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের সহায়তায় এসব অপকর্ম চালাতো তারা। বাংলাদেশ ফিরে গিয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোতে।

ক্ষমতায় আরোহনের পর শুরু করে যথেচ্ছ দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, লুটপাট। আর এই কুকর্মের সংবাদ প্রকাশ করলে সাংবাদিকদের ওপর নেমে আসতো মধ্যযুগীয় বর্বরতা। জেলায় জেলায় সাংবাদিকেরা দায়িত্ব পালনের দায়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতেন, প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই। শুধু দুর্নীতিই নয়, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সাংবাদিক-লেখকেরাও অত্যাচারের শিকার হয়েছেন খালেদা-নিজামীর চামন্ডাদের হাতে।

২০২৩ সালে এসে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা নিয়ে বড় বড় কথা বলেন বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামির নেতারা। তাদের ফেসবুক পেজ, পেইড এজেন্ট নেত্রনিউজ এমনকি মার্কিন দুতাবাসও আওয়ামী লীগ আমলে বাক স্বাধীনতা নেই বলে বিলাপ করছেন। বিএনপি’র সময়ে দেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নমুনা দেখলে পাঠক বুঝতে পারবেন পার্থক্য কোথায়।

কারারুদ্ধ বিবেকঃ সংখ্যালঘু নির্যাতনের তথ্য প্রকাশের দায়ে শাহরিয়ার কবিরকে গ্রেফতার; ২০০১ সালের ২৪ নভেম্বর ভোরের কাগজ-এ প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায় ২২ নভেম্বর ভারত থেকে দেশের ফেরার পরপরই শাহরিয়ার কবিরকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে পুলিশ। এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে সারাদেশে বিএনপি-জামায়াতের সংখ্যালঘু নির্যাতনের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ ও ভিডিও তথ্যচিত্র প্রকাশ করেন শাহরিয়ার কবির। এ কারণে তাকে বিমানবন্দর থেকেই গ্রেফতার করে এসবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখালেও পরে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহ মামলা দেওয়া হয়। সারাবিশ্বের কাছে খালেদা-নিজামী জোটের আসল চেহারা তুলে ধরার অপরাধে তাকে অপদস্থ করে জোট সরকার। গ্রেফতারের প্রতিবাদে অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে বলা হয় আওয়ামী লীগে ভোট দেওয়ার কারনে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। রিপোর্টের প্রতিবাদে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন বলেন, পারিবারিক দ্বন্দের ঘটনাকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া হচ্ছে আর রাজনৈতিক ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া হচ্ছে।

সংবাদপত্রের কন্ঠরোধঃ জনকণ্ঠে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ; ২০০১ সালের ২২ নভেম্বর হতে দৈনিক জনকণ্ঠে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দেয় জোট সরকার। জনগুরুত্বপুর্ণ বিজ্ঞাপনগুলো জনকন্ঠের মতো তৎকালীন অত্যন্ত জনপ্রিয় পত্রিকাকে কোনঠাসা করতে এই পন্থা অবলম্বন করে সরকার। এ প্রসঙ্গে সরকারি বিজ্ঞাপন প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ডিএফপি বলে জনকন্ঠের ভুমিকার কারনেই বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছেনা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তথাপি গনমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করে বিএনপি জামায়াত জোট নিজেদের অপশাসনকে সুসংহত করতে চেয়েছিল। কারণ জোট সরকারের নৈরাজ্যের খবর জনকন্ঠের মত বিশদাকারে আর কেউ ছাপানোর সাহস পায়নি। এরই ফলস্বরুপ বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়ে শাস্তি দিতে চেয়েছিল জোট সরকার

পুলিশ সেজে ফেনসিডিল ছিনতাই ও চাঁদাবাজিঃ খবর প্রকাশের পর সাংবাদিককে হত্যার প্রকাশ্য হুমকি; ২০০১ সালে ২১ নভেম্বর ভোরের কাগহ পত্রিকার প্রকাশিত এক খবরে দেখা যায় সাতক্ষীরার তালা উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিকেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আর মাইকে প্রকাশ্যে তাদের হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এর আগে স্থানীয় রানার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয় একদল যুবদল কর্মী ডিবি পুলিশ সেজে আগৈলঝড়া গ্রামের এক ব্যক্তির ঘরে প্রবেশ করে। তার কাছ থেকে ফেনসিডিল ধরার নাম করে তাকে আটক করে এবং কিছুদুর গিয়ে ৬ হাজার টাকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর রানার পত্রিকার সেই সাংবাদিককে ওই দিনই যুবদলের কর্মীরা তাকে মারধর করে। পরদিন পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। শুধু তাকে ধরেই ক্ষান্ত হয়নি। এরপর পুলিশ আর যুবদলের সেই গ্রুপের নেতারা মিলে অন্য পত্রিকার সাংবাদিকদেরও খুঁজতে থাকে। মাইকিং করে হুমকি দিতে থাকে। যুবদল-ছাত্রদলের ক্যাডারেরা ঘোষণা দেয় ‘ইত্তেফাকের সাংবাদিককে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই শেষ করে দেওয়া হবে।

নামের আগে ‘স্যার’ পরে ‘সাহেব’ কেন লেখা হয়নি, তাই বগুড়ার সাংবাদিককে মারধর করে বিএনপির সাংসদের ক্যাডাররা; বগুড়া-৩ আসনের সাংসদ আব্দুল মোমিন তালুকদার খোকার নামের আগে ‘স্যার’ আর পরে ‘সাহেব’ কেন লেখা হয়নি সেই অপরাধে স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিককে বেধড়ক পেটায় সাংসদের ক্যাডারেরা। ফুটপাত দখলের প্রতিবাদে ১৭ নভেম্বর প্রকাশিত সংবাদে সাংসদ খোকার নাম আসে।

পরদিন ১৮ নভেম্বর তারাবি নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হলে অই সাংবাদিকের ওপর চড়াও হয় বিএনপির সাংসদের ক্যাডার বাহিনী। এমপি সাহেব ডাকছেন বলে তার কলার ধরে আদমদীঘি থানা ও সান্তাহার পৌর বিএনপির কার্যালয়ে নিয়ে যায়। এর ওপর তলাতেই থাকতেন সাংসদ খোকা। নিচে নেমে এসে সাংবাদিককে খোকা বলে ‘স্বয়ং স্পিকার আমাকে সাহেব বলে আর তুই বলতে পারিস না?’ এই কথা শুনে উৎসাহিত হয়ে আরেক দফা প্রহার করে। এর প্রতিবাদে সাংবাদিকেরা বিএনপির খবর বর্জন করেন। এতে আরো উত্তেজিত হয়ে খোকা সাংবাদিকদের বলেন আমার ছেলেরা যদি তোমাদের কিছু করে তার দায়দায়িত আমি নেব না।

Leave a Reply

Your email address will not be published.