প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ আর্জেন্টিনার উত্তরাঞ্চলীয় পাহাড়ি এলাকায় লিথিয়াম প্রকল্পের একটি শক্তিশালী পাইপলাইন চালু হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এটি চালু হলে ইলেক্ট্রিক গাড়ির ব্যাটারি তৈরির গুরুত্বপূর্ণ ধাতুর উৎপাদন বাড়বে। আগামী দুই বছরে তা তিনগুণ হতে পারে।

‘সাদা স্বর্ণ’ হিসেবে রুপালি-সাদা লিথিয়াম ধাতুটির সরবরাহকারী হিসেবে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম দেশ আর্জেন্টিনা। এই খনিজ ধাতু তথাকথিত ‘লিথিয়াম ট্রায়াঙ্গল’-এ অবস্থিত। এই খনিজ কানাডা থেকে চীনা খনি কোম্পানিকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করছে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও বাজারমুখী মডেলের ব্যবহার বাড়ছে। এমনকি অঞ্চলটিতে সম্পদের জাতীয়করণের একটি ঢেউ শুরু হয়েছে।
আর্জেন্টিনার প্রতিবেশী দেশ চিলি হলো বিশ্বের শীর্ষ লিথিয়াম সরবরাহকারী। গত সপ্তাহে দেশটি একটি রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বাধীন সরকারি-বেসরকারি মডেল উন্মোচন করেছে। এতে বিনিয়োগকারীরা কিছুটা ভয়ের মধ্যে আছেন। বলিভিয়া দীর্ঘদিন ধরে অনাবিষ্কৃত সম্পদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। আর মেক্সিকো গত বছর নিজের লিথিয়ামের মজুতের রাষ্ট্রীয়করণ করেছে।
আর্জেন্টিনায় গত বছর রাষ্ট্রীয় জ্বালানি প্রতিষ্ঠান ওয়াইপিএফ লিথিয়ামের অনুসন্ধান শুরু করলেও এই খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে বেসরকারি কোম্পানিগুলো। অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বিরল সম্ভাবনা হিসেবে খনির মাধ্যমে ডলার দেশে আনতে নিয়মিত নতুন নতুন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।
আর্জেন্টিনার চেম্বার অব মাইনিং বিজনেস-এর সভাপতি ফ্রাঙ্কো মিগনাক্কো বলেছেন, গত দশ বছর ধরে প্রকল্পগুলো আর্জেন্টিনা ছাড় দিয়েছে। এর ফলে আজ লিথিয়ামে বিনিয়োগ, উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির সুযোগ এই মাত্রায় পৌঁছেছে।
মিগনাক্কোর ধারণা, ২০২৪-২০৫ সালের মধ্যে আর্জেন্টিনার বর্তমান লিথিয়াম কার্বোনেট উৎপাদন ৪০ হাজার টন থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১ লাখ ২০ হাজার টন। এর ফলে দেশটি লিথিয়াম উৎপাদনে চীনকে ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমানে প্রতি বছর ১ লাখ ৮০ হাজার টন উৎপাদন করা চিলির কাছাকাছি পৌঁছে যাবে আর্জেন্টিনা।
বর্তমানে দুটি উৎপাদনে থাকা দুটি প্রকল্পের পাশাপাশি আরও প্রকল্প চালু হওয়ার ফলে এটি সম্ভব হবে। বর্তমানে দেশটিতে ছয়টি লিথিয়াম প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে এবং ১৫টির উচ্চতর অনুসন্ধান বা সম্ভাব্যতা যাচাই পর্যায়ে রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন মিগনাক্কো।
আর্জেন্টিনার চেয়ে চিলির অবস্থান বিপরীত। দেশটিতে এসকিউএম ও আলবেমার্লে নামে দুটি কোম্পানি লিথিয়াম উৎপাদনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। খুব কম নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। বলিভিয়া সম্প্রতি একটি চীনা কোম্পানিকে নতুন এক প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন।
আর্জেন্টিনার উৎপাদন বাড়বে মূলত দুটি প্রকল্প থেকে। একটি হলো মার্কিন প্রতিষ্ঠান লিভেন্ট-এর ফেনিক্স প্রকল্প, এটি কাটামার্কাতে অবস্থিত। অপরটি হলো জুজুয়তে অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ার অলকেম লিমিটেড-এর সালার ডে ওলারোজ খনি। উভয় খনিতে উৎপাদন আগামী বছরগুলোতে ৪১ হাজার ৫০০ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এই দুটি প্রকল্পের সঙ্গে উৎপাদনে যোগ দেবে চীনের গানফেং লিথিয়াম কোম্পানি এবং কানাডার লিথিয়াম আমেরিকাস কর্প-এর প্রকল্প। ২০২৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধে এই প্রকল্প দুটিতে ৪০ হাজার টন লিথিয়াম কার্বোনেট উৎপাদন হতে পারে।
আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া ও চিলি সম্মিলিতভাবে বিশ্বের বৃহত্তম লিথিয়াম উৎপাদনকারী। কিন্তু উন্নয়ন নিয়ে দেশগুলোর পরিকল্পনা ভিন্ন।
দ্য উইলসন সেন্টার-এর লাতিন আমেরিকা প্রোগ্রামের পরিচালক বেঞ্জামিন গেদান বলেন, আর্জেন্টিনার লিথিয়াম খাত বিকেন্দ্রীকরণ ও বাজারমুখী কৌশলের মাধ্যমে বিকশিত হচ্ছে। বিপরীতে বলিভিয়াতে রাষ্ট্রীয় কঠোর নিয়ন্ত্রণে খাতটি সংকুচিত হয়েছে। চিলি হয়ত মাঝামাঝি কোনও কৌশল পেয়েছে সরকারি-বেসরকারি মডেল হাজির করার মাধ্যমে। এর ফলে হয়ত নতুন লিথিয়াম প্রকল্পে সরকারের হাতে বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ থাকবে, কিন্তু বেসরকারি কোম্পানিগুলোকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেবে।
রাষ্ট্রীয়করণের প্রবণতায় কর্মকর্তাদের মধ্যে অঞ্চলটিতে ওপেক ধাঁচের একটি লিথিয়াম কার্টেল গড়ে তোলার বিষয়টি আলোচনায় আসছে। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, খাতটির বৈচিত্র্যময় মডেল এবং উন্নয়নের এই মাত্রায় এটি অবাস্তব।
মূল্যস্ফীতি ও পুঁজি নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্যে জটিলতাসহ অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আর্জেন্টিনা। চলতি বছরের অক্টোবরে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে। লিথিয়াম পাইপলাইন সম্ভবত দেশটিতে খাতটিকে আরও বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেবে। উৎপাদনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে। তবে প্রতিবেশী চিলিকে ছাড়িয়ে যাওয়া হয়ত সম্ভব হবে না। তবে কিছু বিশেষক উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য নির্ধারণ করছেন।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এবিসিইবি-এর বিশেষক নাতাশা ইজকুইয়ের্দো বলেন, বর্তমানে আর্জেন্টিনার চেয়ে বেশি লিথিয়াম উৎপাদন ও রফতানি করে চিলি। কিন্তু এখন যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে সেগুলো উৎপাদন শুরু করলে হয়ত চিলিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে দেশটি।
সূত্র: রয়টার্স