প্রশান্তি ডেক্স ॥ আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এবারের ঈদুল ফিতরে নেতাকর্মীদের অন্তত ‘হাফ ডজন’ নির্দেশনা দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে অধিকাংশই ছিল ঈদের ছুটিতে ভোটকেন্দ্রিক আগাম প্রচারণা এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ানো নিয়ে। সে অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতা, এমপি ও মন্ত্রীদের ঈদের আগে-পরে নির্বাচনি এলাকায় যান। তারা স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা ও মতবিনিময়ের পাশাপাশি দলীয় প্রধানের নির্দেশনা পৌঁছে দিয়েছেন। এতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা, অন্যেরা পেয়েছেন নির্বাচনের বাতাস।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের কমপক্ষে ছয় নেতা জানিয়েছেন, বিএনপিসহ বিরোধীদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে নেতাকর্মীদের আগেই সতর্ক করা হয়েছে। তাদের নির্বাচন হওয়া পর্যন্ত সব সময় সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এর সঙ্গে এবার ঈদের ছুটিতেই ভোটের জন্য প্রস্তুত হওয়া এবং প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তাদের। বলা হয়েছে, ভোটের আগাম প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি নির্বাচনি বাতাস বেগবান করতে হবে। কেন্দ্র মনোনীত নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য বলা হয়েছে।
তারা বলছেন, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নির্বাচনকেন্দ্রিক দলের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশনার অপেক্ষায় ছিলেন। ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে সেই নির্দেশনা আসায় অনেক নেতা, এমপি ও মন্ত্রী এবার নির্বাচনি এলাকায় গেছেন। অনেকে ঈদের আগে এলাকা ঘুরে গেছেন, অনেকে ঈদের সময় এবং কেউ কেউ ঈদের পরে এলাকায় গেছেন। তারা স্থানীয় নেতাদের কাছে নেত্রীর নির্দেশনা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের জন্য, আগামীতে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করেছেন। এ ক্ষেত্রে ভালো সাড়া মিলেছে নেতাকর্মীদের এবং জনসাধারণের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত বুধবার (২৬ এপ্রিল) আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে নেত্রীর বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন, সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে নেতাকর্মীরা কাজ করছেন। তৃণমূল পর্যায়ে নেত্রীর নির্দেশনা আমরা পৌঁছে দিয়েছি। এখন তারা সে অনুযায়ী দলের জন্য কাজ করবে, ভোট সামনে রেখে জনসাধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াবে।
নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি ভোটের বার্তা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে আগামীতেও নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে বলা হয়েছে। নেত্রীর নির্দেশনাগুলো জেলার সব স্তরের নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়নে সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা এবং এমপি-মন্ত্রীরা নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় সক্রিয় ছিলেন ঈদের ছুটিতে। এর বাইরে আগামী নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারাও নিজেদের মতো করে আলাদাভাবে সক্রিয় রয়েছেন। এর ফলে স্থানীয় নেতাদের নানা বলয়ে বিভক্ত হয়ে ভোটকেন্দ্রিক আগাম প্রচারণা করতে দেখা গেছে অনেক এলাকায়। অনেকের ছিল বলয় ভারী করার প্রচেষ্টা ও কৌশলও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তত তিনটি জেলার আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাদের এলাকার কেন্দ্রীয় নেতারা নিজেদের মতো করে জেলা নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন। দলের এমপিরাও তাদের মতো করে উপজেলা নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন। এই চেষ্টা করছেন যারা আগামীতে নৌকার প্রার্থী হতে চান, তারাও। ফলে ভোটের আগাম প্রচারণা ঈদের ছুটিতে লক্ষ্য করা গেলেও ঐক্যের বদলে বিভক্তিও প্রকাশ্যে এসেছে।
ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা জানান, অন্যান্যবারের চেয়ে এবার দলের নেতা, এমপি ও মন্ত্রীরা ঈদের সময় নিজ নিজ এলাকায় গেছেন সবচেয়ে বেশি। সামনে জাতীয় নির্বাচন থাকায় এবং দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশনার কারণে যারা সচরাচর এলাকায় যান না, এবার তারাও গেছেন। তাদের মাথায় ঘুরছে অতীতের আমলনামা এবং জনপ্রিয়তা দেখে এবার মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি। ফলে যেসব এমপি-মন্ত্রী এবার মনোনয়ন না পাওয়ার ঝুঁকিতে আছেন তারাও বেশ সক্রিয় হয়েছেন। তাদের বিপরীতে মনোনয়ন প্রত্যাশীরাও পাল্লা দিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছেন। এতে নির্বাচনি এলাকাভিত্তিক নেতাদের তৎপরতা বেড়েছে, যা তৃণমূল আওয়ামী লীগকে সক্রিয় করেছে।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ঈদের সময় দিনাজপুরে নিজ এলাকায় থাকার চেষ্টা করি। এবারও ঈদ এলাকায় করেছি। নেত্রীর নির্দেশনা নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারেও তাদের সতর্ক করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে আগামীতেও তাকে ক্ষমতায় আনতে তারা ঐক্যবদ্ধ ও শক্ত অবস্থানে রয়েছে।
বাগেরহাট আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু বলেন, আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় ঈদের সময় খুলনায় থাকতে হচ্ছে। নেত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী মোবাইলে নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। ঈদের ছুটিতে দলের এমপিরা নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় এসেছেন, তারা নেত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছেন। আমরা থানা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যন্ত নেতাদের জনসম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছি।
ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খান সাইফুল্লাহ পনির বলেন, ঈদের সময় এমপিরা, নেতারা সাধারণ মানুষকে কাপড় দিয়েছেন। রোজায় ইফতার ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছেন। কেন্দ্রীয় নেতারা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে দলের জন্য কাজ করতে বলেছেন। জনসাধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে বলেছেন। নেত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আরও বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন নেত্রী। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি, সরকারের সফলতা এবং বিএনপির ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করছি আমরা। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছেও নেত্রীর বার্তা পৌঁছে দিয়েছি। তারা সে অনুযায়ী কাজ করছেন।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নির্বাচনি আগাম প্রচারণা চালালেও বিএনপি নেতারা ভোট নয়, দিয়েছেন আন্দোলনের বার্তা। ফলে ঈদের ছুটিতে তৃণমূল পর্যায়ে উভয় শিবিরের বিপরীতমুখী জনসংযোগ লক্ষ্য করা গেছে এবার। সেটি মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের নেতাকর্মীদের সেই লক্ষ্যে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশনাও দিয়েছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা।
ঈদের আগে গত ১৯ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সভাপতি ও সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, ঢাকা মহানগর শাখা ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে যৌথসভা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সেখানে নির্বাচন সামনে রেখে নেতাকর্মীদের এলাকায় গিয়ে কাজ করতে বলা হয়। যৌথ সভার পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ভিডিও কলে যুক্ত হয়ে ৫-৬টি নির্দেশনা দেন দলটির প্রধান শেখ হাসিনা।
সেগুলো হলো বিরোধীদের সম্ভাব্য নাশকতার ব্যাপারে নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকা, ঈদের ছুটিতে নিজ নিজ এলাকার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে জনসংযোগ করা, সরকারি প্রকল্পের উপকারভোগীদের খোঁজখবর ও সরকারের উন্নয়নের চিত্র মানুষের কাছে তুলে ধরা, বিএনপির অপশাসন ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা এবং তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সময়ের তুলনা করে মানুষকে বোঝানো, স্থানীয় নেতা ও সংসদ সদস্যদের গ্রুপিং না করা এবং যাকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হবে তার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা, কৃষকদের ধান কাটার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা ও সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং উৎপাদন বাড়াতে অনাবাদি জমি না রাখতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা।