প্রশান্তি ডেক্স ॥ দেশের নামিদামি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা বোর্ডের বেশ কয়েকজন অসাধু ব্যক্তির সহায়তায় গত ৮ থেকে ১০ বছর ধরে অনলাইন ভেরিফিকেশন করা সার্টিফিকেট বিক্রি করে আসছিল চক্রটি। প্রতিটি সার্টিফিকেটের জন্য নেওয়া হতো ১ থেকে ৪ লাখ টাকা করে। এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার সার্টিফিকেট নিজেরা বানিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে সরবরাহ করেছে চক্রটি। এমনই এক চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানতে পারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ।
গত বৃহস্পতিবার (৪ মে) রাজধানীর রামপুরা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান এবং তার স্ত্রী নুরুন্নাহার মিতুকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় বিভিন্ন পর্যায়ের অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেট, মার্কশিট এবং নগদ টাকা। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে লালবাগ থানার বড়ঘাট মসজিদ এলাকার কাশ্মীরি গলির একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে গত শুক্রবার (৫ মে) সকালে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ইয়াসিন আলী এবং দারুল এহসান ইউনিভার্সিটির পরিচালক বুলবুল আহমেদ বিপুকে গ্রেফতার করা হয়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, লালবাগের দুই রুমের বাসাটিতে দামি ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার, এমব্রস মেশিন স্থাপন করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগ্রহ করা ব্লাঙ্ক মার্কশিট, সার্টিফিকেট চাহিদা অনুযায়ী ব্যক্তিদের নামে ছাপানো হতো। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ইয়াসিন আলী বিভিন্ন ছাপাখানা থেকে সব ধরনের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য-সংবলিত অতি সূক্ষ্ম জাল সনদের কাগজ, সার্টিফিকেট, মার্কশিট, প্রশংসাপত্র এবং ট্রান্সক্রিপ্ট ছাপিয়ে এনে বিভিন্ন গ্রাহককে সরবরাহ করতো।
এই চক্রটি দুই ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত উল্লেখ করে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, কোনও ধরনের ভেরিফিকেশন হবে না এরকম সার্টিফিকেট, মার্কশিট, প্রশংসাপত্র সরবরাহ করতো চক্রটি। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম এখন আর নেই সেসব বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট জাল করে বিভিন্ন লোকজনের কাছে সরবরাহ করতো। এটির জন্য প্রতি গ্রাহকের কাছ থেকে তারা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা করে নিতো। দেশে-বিদেশে অনলাইনে ভেরিফিকেশন হবে, এরকম মার্কশিট সার্টিফিকেটও সরবরাহ করতো চক্রের সদস্যরা। এ ধরনের সার্টিফিকেট গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১ থেকে ৪ লাখ টাকা করে নিতো চক্রটি। এতে জড়িত রয়েছে বিভিন্ন নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অসাধু কর্মকর্তাও। বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, এ চক্রের সদস্যরা গত ৮ থেকে ১০ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েট সার্টিফিকেট তৈরি করে বিভিন্ন লোকজনের হাতে পৌঁছে দিয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন বোর্ডের সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার মার্কশিট এবং সার্টিফিকেট ক্রয় বিক্রয় করে আসছিল। সার্টিফিকেট ও মার্কশিটগুলো বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরবরাহ করা মূল কাগজ দিয়েই তৈরি করা হয়। সেগুলোকে কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনলাইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাতে অনলাইন ভেরিফিকেশনে সত্যতা মেলে।
জাল সার্টিফিকেট বিক্রির টাকা দিয়ে চক্রের সদস্যরা রাজধানীতে লাক্সারিয়াস জীবনযাপন করে আসছিল। এসব টাকা দিয়ে তারা ডেভেলপার কোম্পানি বানিয়েছে, লাক্সারিয়াস ফ্ল্যাট কিনেছে। এক একটি সার্টিফিকেট তৈরিতে তাদের খরচ হতো ৫০ থেকে ১০০ টাকা। এরমধ্যে প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান বেশ কয়েকবার বিজনেস ভিসায় বিদেশে গিয়েছে। মানি লন্ডারিংয়ের কোনও বিষয় রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। সিআইডির সহায়তা নেওয়া হবে।
লালবাগ গোয়েন্দা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কতজনের কাছে এ ধরনের জাল সার্টিফিকেট গেছে, এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে রিমান্ডের আবেদন করা হবে। এসব জাল সার্টিফিকেট যাদের হাতে গেছে তাদের কারণে প্রকৃত শিক্ষার্থী যারা ভালো রেজাল্ট করেছে, চাকরি ক্ষেত্রে তাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে বলে মনে করি। এসব বিষয় আমরা খতিয়ে দেখছি।’ তিনি বলেন, ‘নামিদামি যেসব বিশ্ববিদ্যালয় এবং বোর্ডের দায়িত্বশীল অসাধু ব্যক্তির নাম পেয়েছি তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’