মধ্যপ্রাচ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের পতনের শুরু

প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ চীনের সরকারি বার্তাগুলোতে প্রায় সময় চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের একটি কথা বারবার তুলে ধরা হয়। আর তা হলো, ‘শতাব্দীর বড় পরিবর্তনগুলো এখনও অদেখা রয়ে গেছে’। এই কথাটি পুনর্বার সামনে আনাকে প্রোপাগান্ডার চেয়ে বড় কিছু, বিশ্ব ব্যবস্থায় বৃহত্তর পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত বলে মনে করা হচ্ছে।

বছরের পর পর বছর ধরে সৃষ্ট এই পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতিও। ২১ শতকে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক আধিপত্য দেখা গেছে। দীর্ঘদিন এই অঞ্চলে ‘মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে ভূমিকায় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য। চলতি বছরের মার্চে এই অঞ্চলে হস্তক্ষেপ করে চীন। বেইজিং-এর মধ্যস্থতায় দীর্ঘদিনের বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে শান্তি চুক্তিতে সই করে সৌদি আরব ও ইরান। ওয়াশিংটনের সঙ্গে তেহরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক আগে থেকেই নড়বড়ে। এখন রিয়াদের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে।     

প্রবীণ মার্কিন কূটনীতিক চাস ফ্রিম্যান বলেন, ‘আমরা হুমকি দিই, আমরা নিষেধাজ্ঞা জারি করি, আমরা বোমা ফেলি, আমরা সেনা পাঠাই। কিন্তু আমরা কখনোই যুক্তি-পরামর্শ ইত্যাদি দ্বারা কাউকে রাজি করানোর শিল্পকে কাজে লাগাই না।

ফ্রিম্যান ১৯৭২ সালে চীন সফরে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রধান দোভাষী ছিলেন। এই সফর শেষে তাইওয়ানের বদলে চীনকে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি বেইজিং-এ খোলা হয় মার্কিন দূতাবাস। এই দূতাবাসে ফ্রিম্যান ডেপুটি চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি বলেন, ‘ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক গৌরবের মুহূর্ত অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন যা ঘটছে তা হলো অন্যের ওপর জোর খাটানোর মার্কিন ক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে। তবে আমরা এখনও মনে করছি যে বিশ্বে আমরা অপ্রতিদ্বদ্বী। শীতল যুদ্ধের শেষ হওয়ার পর যে কল্পনা আমরা করেছি।’

বর্তমানে অনেক দেশ তাদের নিজস্ব পথ অনুসরণ করছে; যেটাকে কখনও কখনও ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ বলা হয়। ধারণাটি ভারতের জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে রয়ে গেছে। ধারণাটি সৌদি আরবের মতো এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মার্কিন বন্ধুদেরও আকর্ষণ করছে। এপ্রিলে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর মন্তব্যেও এই নীতির আভাস ছিল।

একসময় সৌদি আরবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফ্রিম্যান বলেন, ‘বিশ্ব বদলে যাচ্ছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রাধান্য ধরে রাখা, যা অসম্ভব। কিছুই চিরন্তন নয়। কোনও পরাশক্তি সর্বদা সর্বোচ্চ শক্তি থাকে না। শুধু যে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে চলমান মার্কিন কর্তৃত্বের অবসান ঘটেছে তা নয়, ৫০০ বছরের ইউরো-আটলান্টিক ঊর্ধ্বগামীতারও অবসান হয়েছে।’

‘ক্ষমতার পালাবদল’ : দীর্ঘদিন ধরে এই পরিবর্তনের সুবিধা নিতে নিজেদের তৈরি করেছে চীন। সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ ইউনিভার্সিটির মিডল ইস্ট স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের চীন বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক হংদা ফ্যান বলেন, ‘১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে চীন পারস্পরিক সুবিধা এবং একে-অপরের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও গভীর করে চলেছে’।

তিনি বলেন, ‘কয়েক দশক ধরে অন্যান্য দেশের সংঘাত উসকে দেয়নি চীন। এতে বিশ্ব পরিমন্ডলে চীনের ভাবমূর্তি ইতিবাচক হয়েছে’।

এটা অবশ্য ঠিক যে প্রধান প্রতিবেশীদের সঙ্গে চীনের বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বিরোধ রয়েছে। তারপরও চীন প্রায় ১৩০টি দেশের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা প্রায় ১৫০টি দেশে বিস্তৃত অবকাঠামো প্রকল্পের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলজুড়ে তার অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাবকে শক্তিশালী করেছে।

বিশ্বের এক নম্বর তেল আমদানিকারক চীনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ঘনিষ্ঠ হওয়া বিশেষভাবে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। ইরান ও সৌদি আরব উভয়েই বাণিজ্য ও নিরাপত্তা ব্লক-ব্রিকস প্লাস এবং সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায় জায়গা চায়। তাদের সদস্যপদ বেইজিংকে ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার ওপর আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মতো সম্ভাব্য মার্কিন ব্যবস্থাকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা দিতে পারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারত্বের কেন্দ্রস্থল ছিল তেল। তবে সৌদি সিংহাসনের উত্তরসূরি মোহাম্মদ বিন সালমানকে নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অবস্থান, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে মার্কিন সহায়তা কমিয়ে আনা এবং ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টায় ওয়াশিংটনের সঙ্গে রিয়াদের সম্পর্কের ফাটল ধরতে শুরু করে। যদিও মুসলিম উইঘুর সংখ্যালঘুদের প্রতি চীনের আচরণের নিন্দায় ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ দিয়েছে কয়েকটি মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম দেশ।

অধ্যাপক হংদা ফ্যান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে উন্নয়নের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জরুরি চাহিদাগুলোকে উপেক্ষা করেছে অথবা এটিতে যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি’।

তিনি বলেন, ‘ওয়াশিংটনকে বুঝতে হবে এ ধরনের চ্যালেঞ্জগুলো কেবল চীন থেকে নয়, অন্যান্য অনেক দেশ থেকেও আসে। চীনসহ অনেক দেশ তাদের নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এসব দেশ একটি বহুমুখী বিশ্ব দেখার প্রত্যাশা করে’।

‘পৃথিবী বদলে গেছে’ : সৌদি আরবের ক্ষেত্রে এ কথার অর্থ হলো জ্বালানির প্রভাবকে ভূ-রাজনৈতিক পুঁজিতে রূপান্তর করা। এই পরিবর্তনকে সতর্কতার সঙ্গে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র।

রিয়াদ তেল উৎপাদন বাড়ানোর মার্কিন আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করার পাশপাশি গত অক্টোবরে ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে ‘ওপেক প্লাসে’ যোগ দেওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট এর পরিণাম নিয়ে রিয়াদকে সতর্ক করেছিলেন।

সৌদি আরবের জ্বালানি মন্ত্রীর সাবেক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মোহাম্মদ আল-সাব্বান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে তারা বিশ্বের একমাত্র মোড়ল। এটা আসলে সত্য না’। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব বহুমুখী  হয়ে উঠেছে। সেখানে চীন আছে, রাশিয়া আছে, যুক্তরাষ্ট্র আছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং সৌদি আরবও আছে’।

শুধু তেলের জন্য সৌদি প্রভাবশালীদের তোষামোদ করা হয়, এটা ঠিক না। ইসলামের দুটি পবিত্র স্থানের রক্ষক হিসেবে মুসলিম বিশ্বে অনন্য মর্যাদা রয়েছে সৌদি আরবের। বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশটি আরব লীগ এবং অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি)-এর নেতৃস্থানীয় সদস্যও বটে।

ইতোমধ্যে সৌদি আরব তাদের অভ্যন্তরীণ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিলেও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার ও আধুনিকায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ধর্মের বাইরেও দেশটির একটি জাতীয় পরিচয় গড়ে তুলছেন তিনি। শুরুতে এই রূপান্তরকে স্বাগত জানালেও সময়ের সঙ্গে সে অবস্থান থেকে পিছু হটছে যুক্তরাষ্ট্র।

সাব্বান বলেন, ‘সৌদি আরব তার স্বার্থ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়। বিশেষ করে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। সৌদি আরব অন্য কোনও মত বা তার ওপর আরোপিত মতামতকে গুরুত্ব দেয় না’।

সাব্বান তার দেশের অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক ‘বৈচিত্র্য’-কে যুবরাজ সালমানের ‘ভিশন-২০৩০’ কৌশলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করেছেন। তিনি যুক্তি দিয়ে বলেছেন, সবাইকে সৌদি আরবের স্বার্থকে সম্মান করতে হবে, ঠিক যেমন আমরা অন্যের স্বার্থকে সম্মান করি।

হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌদি আরবের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনও দেশেরই হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়’।

‘একটি গভীর পুনর্মূল্যায়ন’ : সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ৩০ বছর পর মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ঘটনাগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেক কূটনীতিক। যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক, আর্থিক এবং সাংস্কৃতিক খাতে বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলের কাছে নিজেদের আবেদন হারিয়েছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নে শেষ মার্কিন রাষ্ট্রদূত জ্যাক ম্যাটলক বলেন, ‘আজ আমরা যে উদাহরণ বিশ্বকে দিচ্ছি তা ১৯৯১ সালের মতো আকর্ষণীয় নয়’।

ম্যাটলক ১৯৫৬ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার চাকরি শুরু করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘চীনের সাফল্য বিশ্বজুড়ে বইছে। একটি গভীর পুনর্মূল্যায়নকে ওয়াশিংটনের অনুপ্রাণিত করা উচিত, যা অবশ্যই পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত করবে’।

আজ প্রধান প্রতিপক্ষ চীনের সঙ্গে মার্কিন যোগাযোগ সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমন প্রেক্ষাপটে চীন তার ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলোর একটি তালিকা অনুসরণ করে চলছে।

রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, যার শেষ কেউ জানে না। ইরান তার প্রতিদ্বন্ধীদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছে। উত্তর কোরিয়া তাদের পারমাণবিক অস্ত্র বিকাশকে ত্বরান্বিত করছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো এখন আর আগের মতো কাজ করছে না। অন্যদিকে ওয়াশিংটন বিশ্বকে গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারীদের মধ্যে বিভক্ত হিসেবে হাজির করছে।

ম্যাটলক বলেন, ‘মতাদর্শ এবং সরকারের রূপ আসলে কোনও ব্যাপার না। পরিবেশগত অবক্ষয়, সন্ত্রাসবাদ এবং সব ধরনের সহিংসতা, জনসংখ্যার বৃদ্ধি, মহামারির হুমকি এবং পারমাণবিক যুদ্ধ এড়ানো বা গণবিধ্বংসী অন্যান্য অস্ত্রের ব্যবহারের মতো অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম এমন একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ বিশ্বের জন্য সব দেশের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে।’

সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘ধ্বংসপ্রাপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের মতোই মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি সেকেলে বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে। তারা মনে করে বিশ্বকে রূপান্তর করার জ্ঞান এবং ক্ষমতা তাদের আছে কেবল নিজের সামরিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে।’

ম্যাটলকের মতে, এই দৃষ্টিভঙ্গি এমন মনোভাব তুলে ধরে যাতে মনে করা হয়, শীতল যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় হয়েছে, কমিউনিস্টের পতন প্রমাণ করেছে যে পুঁজিবাদ এবং গণতন্ত্র মানবজাতির অনিবার্য ভবিষ্যৎ। পারমাণবিক অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রকে অপরাজেয় করে তুলেছে। তাই বিশ্বকে পরিবর্তন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেওয়া প্রয়োজন। ম্যাটলক বলেন, ‘এগুলো মিথ্যা অনুমান এবং অসম্ভব লক্ষ্য।’ —নিউজউইক অবলম্বনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.