অবৈধ পন্থায় দেশে আসছে আইস এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে

প্রশান্তি ডেক্স ॥ দেশে এই মুহূর্তে মাদক ব্যবহারের শীর্ষে আছে ইয়াবা ট্যাবলেট। এছাড়া বহুকাল ধরেই  প্রচলিত গাঁজা, হেরোইন ও ফেনসিডিল ব্যবহার করে আসছে মাদকসেবীরা। কিন্তু সম্প্রতি নতুন যে মাদকের নাম বেশি শোনা যাচ্ছে, তা হলো ক্রিস্টাল মেথ বা আইস। উদ্বেগজনক হারে এই মাদক সেবন বাড়ছে বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এমনিতেই মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ইয়াবার প্রবেশ ঠেকানো এবং দেশের ভেতরে এর বেচাকেনা বন্ধে হিমশিম অবস্থা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর। এরমধ্যেই নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ভয়ংকর মাদক আইস।

কীভাবে ঢুকছে : ইয়াবার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতিকর এই আইস দেশে ঢুকছে মিয়ানমার ও ভারত সীমান্তের বিভিন্ন জায়গা দিয়ে। কোনও ধরনের আর্থিক লেনদেন ছাড়াই মাদক ব্যবসায়ীরা আইসের চালান নিয়ে আসছে দেশে। আইস বিক্রির পর তারা বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেয় মিয়ানমারের মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে। আর যেসব চালান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে, তখন আর কোনও টাকা দিতে হয় না।

এছাড়া পরিমাণে ছোট চালান হওয়ায় আইস পরিবহন করাও অনেকটাই সহজ। এ কারণে অধিক লাভের আশায় ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এখন হাত বাড়িয়েছে আইসের দিকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, অন্যান্য মাদকের চেয়ে আইসের দাম বেশি হওয়ায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার অভিজাত শ্রেণির মাদকসেবীরা এটা ব্যবহার করতো। অনেকটা তালমিছরির মতো দেখতে এই আইসের দিকে এখন ঝুঁকে পড়ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির নানা বয়সী মানুষও। এ কারণে দেশে আইসসেবীর সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে উদ্বেগজনক হারে।

বাড়ছে চোরাচালান: গত ১৫ দিনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) পৃথক অভিযান চালিয়ে প্রায় ৪৭ কেজি আইস জব্দ করেছে। এ সময় গ্রেফতার করা হয় আট জনকে। যাদের মধ্যে ছিলেন পুলিশের সাবেক এক সদস্যও। তবে অভিযানে মূল মাদক কারবারিদের ধরা যায়নি। এই আট জন ছিল আইসের বাহক।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যে যার মতো অভিযান পরিচালনা করে আইস উদ্ধার ও গ্রেফতার করলেও সমন্বিত কোনও অভিযান এখনও দেখা যায়নি। বছর শেষে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিসংখ্যানে দেখা যায় সবার আলাদা মাদক উদ্ধার ও গ্রেফতারের তথ্য।

বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৩ কেজি ২০০ গ্রাম, ফেব্রুয়ারিতে ৩ কেজি সাড়ে ৬০০ গ্রাম, মার্চে ৫ কেজি সাড়ে ৭০০ গ্রাম ও এপ্রিল মাসে সাড়ে ২৬ কেজি আইস জব্দ করা হয়। চলতি মে মাসের ৯ তারিখ পর্যন্ত জব্দ করা হয়েছে দেড় কেজি আইস।

ব্যবহার বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে: মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, ইয়াবার ভয়াবহতার মধ্যেই দেশের মাদকসেবীদের কাছে আইসের ব্যবহার বাড়ছে ভয়ংকরভাবে। উচ্চবিত্ত ও অভিজাত পরিবারের যারা মাদকসেবী, তাদের কাছে আইস বেশ জনপ্রিয়। আবার যারা ইয়াবায় আসক্ত, তারাও নতুন এই মাদক বেশি পরিমাণে গ্রহণ করছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাবে, দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা এক কোটির বেশি। চিকিৎসায় মাদকাসক্ত নিরাময়ের সংখ্যা অনেকাংশেই কম।

এই সংস্থার কর্মকর্তারা আরও বলেন, বড় একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে সন্তানের মাদকাসক্তের বিষয়টি পরিবারের সদস্যরা এখনও লুকায়। চিকিৎসার বিষয়েও নেই তাদের কোনও তৎপরতা। তারপরও মাদকের ভয়াবহতা ঠেকাতে নেওয়া হয়েছে বাড়তি নজরদারি। দেশব্যাপী অভিযানও পরিচালনা করা হচ্ছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, আইসের কাঁচামাল দুটি দেশ সরবরাহ করে থাকে যথা চীন ও ভারত। এ দুটি দেশ থেকে উৎপাদিত কাঁচামাল মিয়ানমারে চলে যায়। সেখানে বিভিন্ন কারখানায় তৈরি হয় আইস। পরে যা ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশসহ ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস ও থাইল্যান্ডের বাজারে। আর বাংলাদেশে এর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত সীমান্ত, নৌ, স্থলপথ দিয়ে ঢুকছে। এছাড়া মাদকের রুট হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে বাংলাদেশ।

মানবদেহের ক্ষতিও বেশি : মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস) বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ডা. অরুপ রতন চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে তরুণরা ইয়াবার পাশাপাশি আইস মাদকে ঝুঁকছে। এই মাদক সেবনের পর ছয় মাসের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অর্গানে প্রভাব ফেলে। ইয়াবায় যে রাসায়নিক পদার্থ তার চেয়ে এমফিটামিনের পরিমাণ বেশি রয়েছে আইসে। যখন কেউ আসক্ত হয়ে যায় তখন দেখা যায় তা থেকে দূরে থাকতে অনেকটাই কষ্ট হয় তাদের। আর চাহিদার পাশাপাশি জোগান থাকার কারণে হাতের কাছে পাওয়ায় সেবনকারীরাও আরও বেশি আসক্ত হয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, আইস সেবন করলে শারীরিকভাবে চরমভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়ে, শরীরের বিভিন্ন অংশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। হার্ট, ব্রেন, ফুসফুস, মস্তিষ্ক এতে সরাসরি প্রভাবিত হয়।

কী বলছেন কর্মকর্তারা: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ইয়াবা ও আইস দেশে ঢোকার ক্ষেত্রে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে রোহিঙ্গারা। তাদের সরাসরি জড়িত থাকার কারণে দেশে ইয়াবা ও আইসের সরবরাহ বাড়ছে। মাদক মামলার তদন্ত করে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন সামগ্রীর বিনিময়ে মাদকের দাম নির্ধারণ করে থাকে রোহিঙ্গারা। এক্ষেত্রে বড় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে স্বর্ণ। এছাড়া মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও মাদকের টাকা লেনদেন হয়ে থাকে। আর যখন অভিযানে কাউকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়, তখন এসব রোহিঙ্গার পরিচয় মেলে।

শুধু টেকনাফ ও কক্সবাজারকেন্দ্রিক নয়, সারা দেশে মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক জাফরুল্লাহ কাজল বলেন, মাদকের অপতৎপরতা রুখতে দেশব্যাপী কর্মকর্তারা যখনই তথ্য পাচ্ছেন, তখনই অভিযান পরিচালনা করছেন। এসব মাদক উদ্ধারের পাশাপাশি জড়িতদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মাদক চক্রের সঙ্গে জড়িত পরিবহনে সহায়তাকারী ও ঢাকাভিত্তিক মাদক কারবারিদের বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থ লেনদেন, বিশেষ করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মাদকের টাকা পাচারের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সার্বিক বিষয়ে কাজ করছি আমরা।

তিনি বলেন, কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকায় মাদক আইস ও ইয়াবা পাচারের অন্যতম হোতা নবী মাঝি। তার অবস্থান শনাক্ত করতে আমরা কাজ করছি। অন্তরালে থেকে দেশে ব্যবসায়ীদের সহায়তায় মাদক সরবরাহ করছে। মিয়ানমারের মাদক ব্যবসায়ীদের সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছে সে। এছাড়াও তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনতে তদন্ত চলমান রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.