প্রশান্তি ডেক্স ॥ যেকোনও মামলায় বিচারপ্রার্থীদের প্রথমে যেতে হয় অধস্তন আদালতে। ঢাকার মামলাগুলোর জন্য আসতে হয় সিএমএম, সিজেএম, ঢাকা মহানগর বা জেলা দায়রা জজ আদালতে। প্রতিটি আদালতেই রয়েছে আলাদা ভবন। বিচারপ্রার্থী, আসামি, আইনজীবী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের আসা-যাওয়া এসব আদালতে। কিন্তু মানুষের তুলনায় ভবনগুলোতে যে পরিমাণ লিফট সেবা থাকার কথা, তার সংখ্যা খুবই কম। কর্মদিবসে সকাল হলেই ভবনগুলোতে ওঠা নিয়ে চলে এক প্রতিযোগিতা। লিফটের সামনে তৈরি হয় লম্বা লাইন। ২০ থেকে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করে অনেক লিফটের নাগাল পেলেও সবচেয়ে বিড়ম্বনার শিকার হন নারী ও বয়স্ক ব্যক্তিরা।
চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত ভবন ৮ তলার, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালত ভবন ৮ তলার, ঢাকা মহানগর আদালত ভবন ৬ তলার এবং জেলা দায়রা জজ আদালতের ভবন ৬ তলার। এসব ভবনের এক থেকে দুই তলায় উঠতে পারলেও ওপরের তলাগুলোয় যেতে লিফটের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অপর্যাপ্ত লিফট ও ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় বিপত্তি বাধে প্রতি মুহূর্তে। বেশির ভাগ লিফট ১৩ জনের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন হলেও ছয় জনের বেশি উঠতে পারেন না। তাই বয়স্ক ও নারী বা শারীরিক পঙ্গু লোকজনের ভোগান্তি বেশি হয়। বিগত সময়ে লিফট ছিঁড়ে দুর্ঘটনাও ঘটেছিল।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকার অধস্তন আদালতগুলোয় প্রায় ২৭ হাজারের ওপরে আইনজীবী রয়েছেন। যারা এখানে মামলা প্র্যাকটিস করেন। যেমন সিএমএম আদালতে লিফট আছে তিনটি। এর মধ্যে দুটির ধারণক্ষমতা কম, তা-ও আবার সব সময় সচল থাকে না। লিফটে ফ্যান আছে কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। এ ছাড়া ফ্লোর নির্দেশিকা বাটনগুলোও নষ্ট হয়ে পড়ে আছে অনেক দিন ধরে। ফলে লিফটে উঠলে দমবন্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়।
আদালতগুলোয় বাদী, আসামির হাজিরা, জামিনের আবেদনসহ সব দরখাস্ত জমা দেওয়ার সময় ১০টার মধ্যে। এ সময় ধাক্কাধাক্কির মধ্যে পড়তে হয় নারী আইনজীবীসহ বিচারপ্রার্থী নারীদের। লিফটের সেবা ভালো না থাকায় বাধ্য হয়ে তাদের বিকল্প পথ হিসেবে সিঁড়ি দিয়ে যেতে হয়। লিফটে ওঠার জন্য লাইন চলে যায় ভবনের গেটের বাহিরে। অনেক নারী আইনজীবী ভিড় কমার জন্য অপেক্ষা করেন আবার নির্দিষ্ট সময় আদালতে পৌঁছাতে হবে, এ নিয়েও থাকেন বাড়তি মানসিক চাপে।
এদিকে দীর্ঘ লাইনে না দাঁড়িয়ে যারা সিঁড়ি ব্যবহার করেন, ওপরে উঠতে তাদেরও সময় লেগে যায় ২০ থেকে ৩০ মিনিট। এতে ওপরে ওঠার পর হাপিয়ে ওঠেন তারা। শারীরিকভাবে সক্ষম ব্যক্তির কোনও সমস্যা না হলেও অক্ষম বা বয়স্কদের বেলায় তা এক চ্যালেঞ্জ।
সিজেএম আদালত ভবনেও একই অবস্থা। তিনটি লিফট আছে এখানে কিন্তু সেবাপ্রার্থীদের জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। সকাল থেকেই সিরিয়াল লেগে থাকে লিফটের সামনে। আবার সব তলায় থামে না লিফটগুলো। কারও জরুরি কাজ থাকলেও মানুষের ভিড়ের কারণে ওঠার কোনও উপায় নেই। এ সময় বয়স্ক ও নারীরা পড়েন বেশি বিড়ম্বনায়। কারণ ঠেলাঠেলি করে লিফটে ওঠা সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। অনেক আইনজীবী লিফট বিড়ম্বনার কারণে বিভিন্ন আদালতে শুনানিতে অংশ নিতে পারে না।
শুধু সিএমএম এবং সিজেএম নয়, মহানগর দায়রা জজ আদালত ও জেলা দায়রা জজ আদালত ভবনের লিফটের অবস্থারও একই হাল। এই দুই ভবনে আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীদের জন্য লিফট রয়েছে তিনটি। এর মধ্যে মহানগর দায়রা আদালতে দুটি ও জেলা জজ আদালতে একটি। সবগুলো লিফটই ধীরগতির ও ধারণক্ষমতা কম। যেকোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জানা যায়, ২০১৯ সালের ৭ মার্চ ঢাকার জেলা জজ আদালতের পুরনো ভবনের লিফট ছিঁড়ে আইনজীবীসহ ১২ জন আহত হন। ৩৯ বছর ধরে চলা আট ব্যক্তির ধারণক্ষমতার এই লিফটটি অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে ছিঁড়ে পড়ে। দুর্ঘনার সময় লিফটে করে ১২ জন ওপরে উঠছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু বর্তমানে এই লিফটে ৬ জনের বেশি ওঠা যায় না।
এ বিষয়ে ঢাকা জজ আদালতের নারী আইনজীবী মুন্নি আক্তার বলেন, অধস্তন আদালতে নারী আইনজীবী এবং নারী বিচারপ্রার্থীদের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু পর্যাপ্ত লিফট না থাকায় প্রতিনিয়ত ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয় আমাদের ও বিচারপ্রার্থী নারীদের। এ ব্যাপারে যেন দেখার কেউ নেই।
তিনি আরও বলেন, অধস্তন আদালতগুলোয় বাদী, আসামির হাজিরা, জামিনের আবেদনসহ সব দরখাস্ত জমা দিতে হয় ১০টার মধ্যে। এই সময় ধাক্কাধাক্কির মধ্যে পড়তে হয় নারী আইনজীবীসহ বিচারপ্রার্থী নারীদের। সব নারী নিয়মিত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। দ্রুত এ সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
জজ আদালতের আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, লিফটে উঠতে প্রতিদিন দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়, যা মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। মাঝেমধ্যে লিফটগুলো অচল অবস্থায় পড়ে থাকে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনও রকমের পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। যেন এই সেবা নিয়ে সবাই উদাসীন।
এ বিষয়ে ঢাকা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু বলেন, আদালত ভবনে নতুন করে লিফট লাগানোর তো কোনও জায়গা নেই। ভবনের কাঠামোতে নতুন করে লিফট বাড়ানোরও কোনও সুযোগ নেই। তাই কষ্ট করেই সবাই চলছেন। তবে যে লিফটগুলো আছে, সেগুলো ঠিক করে বা পরিবর্তন করে নতুন লাগানো যেতে পারে। যাতে ছয় জনের লিফটে ১০ জন আর ৮ জনের লিফটে ১৫ জন উঠতে পারে।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার গোলাম কিবরিয়া জোবায়ের বলেন, আদালতে আইনজীবী বিচারপ্রার্থীদের তুলনায় লিফট খুবই কম। এ ছাড়া অফিস টাইমে চলন্ত অবস্থায় অনেক সময় লিফট নষ্ট হয়ে যায়। প্রায়ই ঘটে এমন ঘটনা। আর লিফট কম হওয়ার নারী ও বৃদ্ধদের ওঠানামার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা হয়।
তিনি আরও বলেন, সংশ্লিষ্ট যারা আছেন, তাদের নোট দিলেও ফাইল রেডি হয়ে আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়। তাই আমার দাবি, এ বিষয়তি আদালতের নজরে এনে দ্রুত এর সমাধান করা হোক। বিশেষ করে সিএমএম আদালতে একটি ট্যাবলেট লিফট স্থাপন করা হোক।