জঙ্গি তৎপরতার তথ্য জানাতে মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশ

প্রশান্তি ডেক্স ॥ সন্ত্রাস ও নাশকতা ছাড়াও জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের। মাঠ পর্যায়ের এসব কর্মকর্তার বিশেষ কোনও মতামত বা সুপারিশ থাকলে সেটাও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখাকে জানাতে বলা হয়েছে। কোরবানির ঈদের আগে জুনের প্রথম দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয় এই নির্দেশনা। কারণ, আর কয়েক মাস পরই দেশে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে-বিদেশে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

গুলশানের হলি আর্টিজানে ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঘটেছিল ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘটনা। সেদিন বাংলাদেশে জঙ্গিদের মরণছোবল দেখেছিল গোটা দুনিয়া। বিদেশি নাগরিকসহ নৃশংস হতাহতের ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে সর্বস্তরের মানুষ। এরপরই পুলিশ ও র‍্যাবসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ ও দমনে নেওয়া হয় নানা পদক্ষেপ।

হলি আর্টিজানে হামলা ঘটনার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ‘কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)’ নামে একটি বিশেষায়িত টিম থাকলেও পরে ‘অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট’ নামে পুলিশের আলাদা বিশেষায়িত ইউনিট গঠন করা হয়। বর্তমানে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও নির্মূল হয়নি এখনও। মাঝে মধ্যেই জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়। গত বছরের (২০২২) ২০ নভেম্বর রাজধানীর পুরান ঢাকার আদালত পাড়া থেকে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি— আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ও মাইনুল হাসান শামীমকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাটিও ভাবিয়ে তোলে সবাইকে। তাদের অবস্থান সম্পর্কে এখনও সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা  বাহিনীগুলো।

হলি আর্টিজান হামলার ৭ বছরের প্রাক্কালে গত ২৩ জুন দিবাগত রাতে সপরিবারে গ্রেফতার করা হয় নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়ার প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজকে। তার স্ত্রী নাজনীনও এই সংগঠনের সদস্য হিসেবে নারীদের মধ্যে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাতো বলে জানায় সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান। সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা সদস্যদের ওপর এই শামিন মাহফুজের নেতৃত্বেই হামলা হয়েছিল কিছু দিন আগে। বিগত ৬ মাসে সিটিটিসি জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ৬৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। জঙ্গিদের নানামুখী তৎপরতা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের কারণে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তাদের সব কার্যক্রমও নজরদারিতে রাখা সম্ভব হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হলি আর্টিজানে হামলার আগে থেকেই জঙ্গিরা টার্গেট কিলিং শুরু করে। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে সন্ত্রাস, নাশকতা ও জঙ্গি তৎপরতা প্রতিরোধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময় জঙ্গিবাদী ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশনার আলোকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সাধারণ মানুষকে সামাজিকভাবে সচেতন করার পাশাপাশি উগ্র ও জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম চালু রেখেছে।

উগ্রবাদীরা কোরআন ও হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে বিকৃত প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। পুলিশের উদ্যোগে সেগুলোর কাউন্টার ন্যারেটিভ বা প্রকৃত ব্যাখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে জঙ্গি ও উগ্রবাদ প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইমামদের মাধ্যমে জুমার নামাজের খুতবায় জনসাধারণকে সচেতন করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতেও সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা অব্যাহত রাখা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সই করা নির্দেশনামূলক একটি প্রতিবেদন গত ৬ জুন পাঠানো হয় সব সংস্থার প্রধানদের কাছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকানোর জন্য সংঘটিত সন্ত্রাসী ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের প্রচলিত আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছিল তিন হাজার ৭৮৬টি। এরমধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় ৩ হাজার ৫৪৯টির। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ১৮৬টি মামলার। নানা কারণে এখনও তদন্ত শেষ হয়নি ৫১টি মামলার। এছাড়া ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ওই বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সারা দেশে সহিংসতার ঘটনায় দায়ের হয়েছিল এক হাজার ৮২৬টি মামলা। অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে এক হাজার ৭৮৯টির, আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয় ৩৩টি মামলার। ৪টি মামলা এখনও তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্তাধীন মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করা, অভিযোগপত্র দেওয়া মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া মনিটরিং করা এবং স্থগিত মামলাগুলো সচল করার ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদর দফতরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা এবং জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে এরইমধ্যে পুলিশ তাদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে পেরেছে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পুলিশ ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে অবস্থান করছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.