প্রশান্তি ডেক্স ॥ রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর এলাকা থেকে চন্দ্রিমা উদ্যানে ঘুরতে আসেন সোহেল রানা (২৮)। চাঁদপুর থেকে ঢাকা এসেছেন বেশি দিন হয়নি। কাজের সুবাদে মিরপুরেই একটি মেসে থাকেন। ঢাকা শহর খুব একটা ঘুরে দেখা হয়নি তার। তাই সুযোগ পেলেই নগরের বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রে ঘুরতে যান।
শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় এক বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে যান রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে উদ্যানে লেকের পাড় ধরে হাঁটছিলেন তারা। আচমকা এক তরুণী গা ঘেঁষে এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। নিজ থেকেই নানারকম ইশারা-ইঙ্গিত দিতে থাকে। কী ঘটছে প্রথমে বুঝতে না পারলেও কয়েক সেকেন্ড পরে তারা বুঝতে পারেন। ওই তরুণী তাদের উদ্দেশ করে অনর্গল বলতে থাকেন উদ্যানের সাইডে বসবেন? নাকি রিক্সায় চড়বেন, না হোটেলে যাবেন? ওই তরুণীকে পাশ কাটাতে না কাটাতেই দুই জন লোক তাদের পিছু নেয়। নানাভাবে তাদের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করে ওই দুই জন। একসময় তাদের দাঁড় করিয়ে ফার্মগেট কোন দিকে জানতে চায়। মুহূর্তেই সোহেল রানা ও তার বন্ধু বুঝতে পারেন এরা প্রতারক বা ছিনতাইকারী। বুঝতে পেরে কৌশলে তাদের কাছ থেকে ছুটে আসেন।
এর কিছুক্ষণ পরে দেখা যায় আরেক দৃশ্য। উদ্যানের লেকের দেয়ালের ওপর বসে বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন এক তরুণী। একা হওয়ায় তিনিও পড়েন বিড়ম্বনায়। বন্ধু আসার আগ পর্যন্ত পড়েন বেকায়দায়, বিশ্রী পরিস্থিতিতে। কেউ পাশে এসে বসছে, কেউ সামনে দাঁড়িয়ে থাকছে, আবার কেউ বলতে চেয়েও কিছু বলছে না। তরুণী টের পেয়ে সেখানে থেকে অন্য স্থানে সরে বসলেন। সেখানেও তার পাশে ঘুরঘুর করতে থাকে এসব ছেলে।
গত ২২ জুন ও ২৩ জুন সন্ধ্যার পর এসব এলাকায় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে সরেজমিন এমন চিত্রই দেখা গেছে। এসব এলাকায় ছুটির দিনে কিংবা কাজের ফাঁকে, অবসর সময়ে ঘুরতে বের হলেই তাদের মতো অনেককে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। তবুও নগরবাসীর বিনোদনের জায়গা কম হওয়ায় অনেকে আসেন। ভুক্তভোগী তাকমিনা আক্তার অভিযোগ করে বলেন, উদ্যানের ভেতরে-বাইরে নানা ধরনের মানুষ আসেন। এই খারাপ লোকদের কারণে প্রকৃত দর্শনার্থীরা বিড়ম্বনায় পড়েন। আমাকে বাধ্য হয়ে কয়েকজনকে ‘সরে দাঁড়ান’ বলতে হয়েছে। কারণ আমি একা বসে আছি বলে লোকজন ভাবছে আমিও ওদেরই দলের। উদ্যানের চারপাশের ভাসমান যৌনকর্মীদের না সরালে লোকজন এমন পরিস্থিতিতে পড়বেই।
ভুক্তভোগী সোহেল মিয়া বলেন, আমি মনে করি প্রতারক ও এসব যৌনকর্মীরা একই দলের। কারণ কোনও যৌনকর্মীর কাছে কোনও লোক গেলে একটু দূর থেকে এসব প্রতারক ফলো করে। পরে সুযোগ বুঝে তাদের বিভিন্ন ভয় দেখিয়ে সব কিছু ছিনিয়ে নেয়। আমরা একটু সচেতন, তাই বিষয়টি বুঝতে পেরেছি। হঠাৎ কেউ এখানে ঘুরতে আসলে তাদের পাল্লায় পড়ে সব কিছু হারাতে পারে।
গত ৪ বছর ধরে চন্দ্রিমা উদ্যানে হেঁটে বাদাম বিক্রি করেন স্বপন মিয়া। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত অবস্থান করেন ওই এলাকায়। উদ্যানের আশেপাশে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুই তার চোখে পড়েছে। স্বপন বলেন, দিনে তেমন কোনও সমস্যা হয় না। সন্ধ্যার পর বিভিন্ন ধরনের লোকজন আসতে থাকে। বিশেষ করে যৌনকর্মীদের আনাগোনা বেশি। উদ্যানের সামনের ফুটপাতে একটু পরপর দাঁড়িয়ে থাকে এসব নারী। যারা সঙ্গে যায় উদ্যানের ভেতর নিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা, মোবাইল ছিনিয়ে নিতে শুনেছি। শুধু এসব নারী নয়, কিছু যুবকও রয়েছে। উদ্যানের ভেতরের দিকে ঢুকে পেছনে গিয়ে নানা অপকর্ম চালায়। পরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের পাশ দিয়ে দেয়াল টপকে বের হয়ে যায়। এসব নিয়ে মাঝেমধ্যে ঝামেলা হয়। সারাক্ষণই পুলিশ থাকে, তারপরও তারা থামে না। সন্ধ্যা হলেই তাদের দখলে থাকে ফুটপাত।
দীর্ঘদিন ধরে চন্দ্রিমা উদ্যান ও সংসদ ভবনের আশেপাশে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে আসছেন ডিএমপির পুলিশ সদস্য সালাউদ্দিন। তার মতে, আগের তুলনায় এসব এলাকায় অপরাধ অনেক কমেছে। তিনি বলেন, চন্দ্রিমা উদ্যানে আগে অপরাধীদের আড্ডা ছিল। বর্তমানে নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেওয়ায় এসব লোকজনের উৎপাত নেই বললেই চলে। আগে তো প্রকাশ্যে চন্দ্রিমা উদ্যানের ভেতরে যৌনকর্মী, মাদকসেবীরা আড্ডা দিতো। এখন ২৪ ঘণ্টা পুলিশ থাকে। আগের মতো সুযোগ এখন আর নেই। পাশেই পুলিশের আরেকজন সদস্য বলেন, আমরা বারবার এদেরকে সরিয়ে দেই, ঘুরে আবার আসে। আপনি কতবার সরাবেন। বেশি কিছু বলতে গেলে নোংরা কথা বলে। তখন চাইলেও কিছু বলা যায় না।
একইচিত্র দেখা যায় রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউর সংসদ ভবনের সামনের ফুটপাতে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হলেও এসব ফুটপাতে সন্ধ্যা নামলেই জড়ো হয় ভাসমান যৌনকর্মীরা। দলে বেধে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাদের। এসব এলাকায় যৌনকর্মীদের কেন্দ্র করে উৎপাত রয়েছে প্রতারকদের। অথচ সংসদ ভবনের সামনে বাইরের ফুটপাত দিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন শ্রেণির হাজার হাজার মানুষ ফার্মগেট থেকে খামারবাড়ি হয়ে হেঁটে বাসায় বা গন্তব্যে ফিরেন। আসেন শত শত বিনোদনপ্রিয় মানুষ। চলার পথে, বাসায় ফেরার পথে এসব পথচারীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
এ প্রসঙ্গে শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া বলেন, এসব এলাকায় আমাদের টহল পুলিশ সবসময় থাকে। এভাবে যৌনকর্মীদের চলাচল করার সুযোগ নাই। যদি এইরকম কিছু থেকে থাকে তাহলে খোঁজ নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেবো। এছাড়া এ বিষয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগও আসেনি। যদি কেউ অভিযোগ করে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।