বাআ॥ সবার স্বার্থেই ইউক্রেইন যুদ্ধের দ্রুত শান্তিপূর্ণ সমাপ্তিতে গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতার মধ্যে ভবিষ্যতের ধাক্কা সামলাতে ঝুঁকিতে থাকা সম্প্রদায়ের টিকে থাকার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুরি।
তিনি বলেন, দীর্ঘায়িত এ যুদ্ধ এবং একের পর এক নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা বিশ্বকে অস্থিতিশীল করে চলেছে। যুদ্ধের প্রতিটি দিন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে এবং বিশ্বের দূরতম প্রান্তেও অনেক জীবন কেড়ে নিচ্ছে ও ধ্বংসের চিহ্ন রাখছে।
শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপের (জিসিআরজি) বৈঠকে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে বক্তৃতাকালে সবার জন্য বিপদ ডেকে আনা এ যুদ্ধ বন্ধের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন বলে জানিয়েছে বাসস।
শেখ হাসিনা বলেন, দুঃখজনকভাবে আমরা আজকে যখন ক্রমবর্ধমান সংকট এবং মানবতার ওপর এর বিধ্বংসী প্রভাব নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি, তখন ইউক্রেনে সংঘাত চলছে।
প্রকৃতপক্ষে প্রতিদিন যুদ্ধে নতুন নতুন অত্যাধুনিক অস্ত্রব্যবহার করা হচ্ছে,যা আরও বেশি ধ্বংস ডেকে আনছে এবং সারা বিশ্বের মানুষের জীবনে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
যুদ্ধের প্রভাবে দারিদ্র্য ও বৈষম্য তীব্রভাবে বাড়ছে এবং গরীব দেশগুলো ঋণের বোঝায় চাপা পড়ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এসব সমস্যা এবং অন্যান্য ধাক্কা বিশ্বজুড়ে খাদ্য, শক্তি ও অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। যার ফলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অগ্রগতিতে দেরি হচ্ছে।
বাংলাদেশও জ্বালানি ও খাদ্য আমদানিকারক দেশ হিসেবে ক্রমবর্ধমান আমদানি ব্যয়, মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজাভের্র চাপে ভুগছে বলে শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় তুলে ধরেন।
এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ভবিষ্যতের ধকল সামলে সহনশীলতা তৈরি করতে তার কয়েকটি নির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “আমাদের জরুরিভাবে একটি সংস্কার করা আন্তর্জাতিক আর্থিক কাঠামো প্রয়োজন, যা স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বিনা শর্তে রেয়াতি, স্বল্প-মূল্যের ও স্বল্প সুদের তহবিলে প্রবেশাধিকারসহ আর্থিক সুবিধা দেবে।
এমন জরুরি অবস্থার সময় তিনি আইএমএফের এসডিআর তহবিল এবং সংকট ও বিপর্যয়কালীন তহবিল থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সহজ অর্থায়নের ব্যবস্থা করার তাগিদ দেন। এছাড়া আইএফআই ও এমডিবি থেকে কম সুদে তহবিল প্রাপ্তির সুযোগ থাকার কথাও বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা দ্বিতীয় প্রস্তাব দিয়ে বলেন, যে কারণগুলো খাদ্যের মূল্য ও সরবরাহ-প্রাপ্তিকে প্রভাবিত করে- যেমন রপ্তানি বিধিনিষেধ, মজুদ ও সরবরাহ চেইনে বাধা – এসবের সুরাহা করতে হবে।
“এ প্রসঙ্গে আমরা খাদ্য সরবরাহের উন্নতিতে (জাতিসংঘ) মহাসচিবের বাজার উন্মুক্ত রাখা, রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা অপসারণ এবং মজুদ খাদ্য ছেড়ে দেওয়ার আহ্বানকে পূর্ণ সমর্থন করি।“
প্রধানমন্ত্রী ব্যাক সি ইনিশিয়েটিভের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, মানুষকে খাদ্য দিতে এবং জীবন বাঁচাতে এটি আরও সম্প্রসারণ করা দরকার।
তৃতীয় পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ জ্বালানি সংমিশ্রণ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে জ্বালানি আমদানি কমানোর পাশাপাশি জ্বালানি শক্তিকে বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশর সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “নীতি সহায়তার পাশাপাশি জ্বালানি খাতে ও সবুজ জ্বালানির রূপান্তরে স্থানীয় সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে জ্বালানির রূপান্তর কার্যক্রমকে সহায়তা দেয় আমাদের সরকার।“
খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তন পরস্পর সম্পর্কিত উল্লেখ করে শেখ হাসিনা তার চতুর্থ চিন্তাধারায় বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে- যা বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তীব্রতা বাড়ায়।
“এটি আবার কৃষি, খাদ্য উৎপাদন এবং মানুষের বাস্তুচ্যুতিকে প্রভাবিত করে। তাই টেকসই জ্বালানি, খাদ্য উৎপাদনে উত্তরণ এবং জলবায়ু পদক্ষেপ অপরিহার্য।
জিসিআরজির তিনটি ‘পলিসি ব্রিফ’ থেকে এর সুপারিশগুলো গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এ ওয়ার্ল্ড অব ডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনটই চমৎকার, যা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বৈশ্বিক ঐকমত্যকে সহজতর করবে। সবার স্বার্থ সংশিষ্ট ‘গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসাগুলো’ চলমান রাখতে হবে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বর্তমান কঠিন সময় মোকাবিলা করে জনগণের সহায়তায় তার সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। এসব পদক্ষেপ অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর কিছু লক্ষণ প্রকাশ করে যা স্বস্তির অনুভূতি দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, আমাদের এ পর্যায়ে পৌঁছাতে কিছু কঠিন আর্থিক ও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমাদের অপ্রয়োজনীয় ও বিলাস দ্রব্য আমদানি সীমিত করতে হয়। জ্বালানি খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে হয়, সরকারি খাতে সামগ্রিক ব্যয় কমাতে হয়।
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আইএমএফের কাছ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে রাখতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় এবং জনগণকে কোনো জমি অনাবাদি জমি না রেখে খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতে হয়।
তিনি বলেন, আমরা গুরুত্ব সহকারে নিশ্চিত করেছি যে, কোনো ব্যক্তি যাতে খাদ্যের অভাবের শিকার না হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২৩ সালে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের কথা রয়েছে। ‘আমরা ‘ক্ষয়ক্ষতি তহবিল’ এ সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি এবং বিদ্যমান জলবায়ু তহবিলে প্রবেশাধিকার সুবিন্যস্ত হয়েছে দেখতে চাই।
“এছাড়া শিপিং খাতে প্রস্তাবিত কার্বন শুল্ক দ্বারা উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়। আমরা জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় গ্লোবাল শিল্ডের আওতায় বিভিন্ন প্রকল্পগুলো চালু হয়েছে এমনটি দেখতে পাব বলে আশা করছি। নিজস্ব গ্রিন বন্ড ডিজাইন এবং চালু করার জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এই সমস্ত এবং অন্যান্য সমস্যা সমাধানে বিশ্বব্যাপী ঐকমত্য এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অপেক্ষায় রয়েছি।