‘বিবাহিত মেয়েদের দায়িত্ব স্বামীদের’, বিশ্ববিদ্যালয়ের না!

প্রশান্তি ডেক্স ॥ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আবাসিক সুবিধা, বসবাসের শর্তাবলি এবং আচরণ-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা ২০২১ এর ১৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী, বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীরা হলে সিট পাবে না। সে অনুযায়ী, বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব হল কর্তৃপক্ষ ওই হলে থাকা বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের নোটিশ দিয়েছে। হল কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘বিবাহিত মেয়েদের দায়িত্ব স্বামীদের। সঙ্গতি নেই এমন অবিবাহিতদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে হলে থাকার সুযোগ দেওয়া হবে।’

অন্তঃসত্ত্বা ও বিবাহিতরা হলে থাকলে কর্তৃপক্ষকে কী ধরনের জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়, জানতে চাইলে হল প্রভোস্ট ড. দীপিকা রাণী সরকার বলেন, ‘আমাদের সমস্যার চেয়ে অন্য শিক্ষার্থীদের সমস্যা বেশি হয়। তারা বিভিন্ন সময়ে আমাদের কাছে অভিযোগ করে যে, অন্তঃসত্ত্বা রুমমেটের কারণে তাদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়।’

হল কর্তৃপক্ষও কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘হলে রাতে কোনও হাউসটিউটর থাকেন না। রাতে যদি অন্তঃসত্ত্বা শিক্ষার্থীদের কোনও সমস্যা হয়, তাহলে তাদের কে দেখবে? সেই দায় হল কর্তৃপক্ষ কীভাবে নেবে। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের নিয়মই নাই রাখার।’ সেক্ষেত্রে বিবাহিত শিক্ষার্থীরা কী সমস্যা করলো জানতে চাইলে প্রভোস্ট ড. দীপিকা রাণী সরকার বলেন, ‘বিবাহিত শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব তাদের স্বামীরা নিতে পারেন। বড় বড় জায়গায় চাকরি করেন, তারা চাইলেই তাদের স্ত্রীকে অন্য জায়গায় রাখতে পারেন। অবিবাহিত, পিতা মাতা নেই, এমন শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করে বিবাহিতদের রাখা সম্ভব না। আমাদের মাত্র ৮০০ সিট, সেখানে ১২০০ শিক্ষার্থী থাকে।’

যদিও এই হল প্রভোস্টের কোনও দাবির সঙ্গেই বিবাহিত, অবিবাহিত বা অন্তঃসত্ত্বা শিক্ষার্থীরা একমত নন। তারা বলছেন, অনেক বিবাহিত নারী আছেন, যাদের পরিবার ঢাকার বাইরে থাকে। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি নিরাপদ হলে একটি সিট পাওয়ার অধিকার রাখেন। তার স্বামীর টাকা আছে কী নেই, সেটা দেখার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের নয়। যে বিধানের মাধ্যমে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেটার অস্তিত্বের বিষয়ে কেউ জানতোই না। কীভাবে এ রকম একটা বিধান বিশ্ববিদ্যালয়ের থাকে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তারা।

জানা যায়, ২৫ সেপ্টেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলে আসন বরাদ্দ পাওয়া বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের হল ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। হলটির প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. দীপিকা রাণী সরকারের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় ‘হলের আবাসিকতা লাভ ও বসবাসের শর্তাবলি এবং আচরণ ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা ২০২১ এর ১৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী, বিবাহিত ও গর্ভবতী ছাত্রীরা হলে সিট পাবে না। তারা অতিদ্রুত হলের সিট ছেড়ে দেবে। অন্যথায়, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এদিকে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় ‘বিবাহিত’ স্ট্যাটাসের ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বলে মনে করেন নারী অধিকারকর্মীরা। এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের অধিকারবঞ্চিত করবে। বিবাহিত বা অন্তঃসত্ত্বা শিক্ষার্থীরা প্রয়োজন ছাড়া হলে থাকে, এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই।

গত বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) হল কর্তৃপক্ষের নির্দেশনাটি প্রত্যাহার করতে জবি প্রশাসনকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. সোলায়মান তুষার।

নোটিশের অনুলিপি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর ও হলের প্রভোস্টকে পাঠানো হয়। নোটিশে বলা হয়, ‘যে বিধান মেনে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেই বিধানের ফলে কার্যত বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীরা হলের আবাসিক সুবিধা গ্রহণ করে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে ছাত্রীদের মধ্যে মারাত্মক অসন্তোষ এবং ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নোটিশ প্রাপ্তির পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক বিধানটি বাতিল করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অন্যথায়, উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হবো।’

কেন আইনের আশ্রয় নিতে গেলো শিক্ষার্থীরা, সেই প্রশ্ন তুলে এখন হল কর্তৃপক্ষ বলছে, এখন আমরা আর কোনও কনসিডারেশনে যাবো না। আমরা আরও কঠোর হবো। তারা আমাদের কাছে এক-দুই মাস সময় চাইতে পারতো। সেটা না করে আইনের আশ্রয় নেওয়ায়, আমরা আর অন্যভাবে বিবেচনায় নিতে পারবো না। তবে আমরা এখনও নোটিশ পাইনি, গণমাধ্যমে দেখেছি।

২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর বিয়ের পর তার আবাসিক হলের সিট বাতিল করা হলে জানা যায় সেখানেও বিবাহিত শিক্ষার্থীদের সিট না দেওয়ার ‘নিয়ম’ চালু আছে। যদিও আশ্চর্যজনকভাবে এ ব্যাপারে আদতে লিখিত কোনও আইন বা নিয়ম নেই, যা উল্লেখ করা যেতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের নিয়ম থাকা কতটা সঙ্গত জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখনও এমন বিধানের কথা শুনতাম, কিন্তু চোখে দেখিনি কোনোদিন। এটা যদি আসলেই থেকে থাকে, তাহলে তা ভীষণরকম অন্যায্য। আমরা দাবি করি যে, সভ্যতার দিক থেকে এগিয়েছি। এই চলার পথে নানা বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বিধান আইন বদলেছি। আমরা সামনে এগোচ্ছি মনে করলে, এ রকম বিধান থাকার কোনও মানে হয় না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.