শেষ অধিবেশনে বিরোধীদলের এমপিদের কণ্ঠে বিদায়ের সুর

প্রশাান্তি ডেক্স ॥ গত বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) শেষ হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন। এদিন সংসদে সাতটি বিল পাস হয়েছে। বিলগুলো পাসের সময় বিরোধী দলের বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য কয়েক দফায় সংসদে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। বিরোধী দলের সদস্যরা তাদের বক্তব্যের সময় বারবার অধিবেশন শেষ হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে আনেন। আবার দেখা হবে কিনা, সেই বিষয়টিও সামনে আনেন। কোনও কোনও সদস্য বিদায় সম্পর্কিত কবিতার পঙক্তিও পাঠ করেন। এ সময় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর ভূমিকারও ভূয়সী প্রশংসা করেন বিরোধী দলের এমপিরা। সব মিলিয়ে তাদের কণ্ঠে ছিল বিদায়ের সুর।

বিলের ওপর আলোচনাকালে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম স্পিকারকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনার নেতৃত্বে আমরা এই ১০ বছর (দুই টার্ম) কাটালাম। এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনি জীবনে আরও এগিয়ে যান। আরও নেতৃত্ব দেন।

তিনি বলেন, আজকে আবহাওয়াটা এমন হয়েছে, যেন আজকেই শেষ।  আগেই বলেছি, আজকে বোধহয় শেষ হবে। আমরা কে কী কোথায় কীভাবে থাকি জানি না। পরে তিনি ‘তবু মনে রেখো‘ কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। তার আবৃত্তি করা কবিতাটির অংশ ছিল ‘তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে। যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।যদি থাকি কাছাকাছি, দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি… তবু মনে রেখো। যদি জল আসে আঁখিপাতে, একদিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে, তবু মনে রেখো।’

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক (চুন্নু) বলেন, আমি একটু অন্যভাবে বলতে চাই। একটু বিষাদের মতো। বলতে চাই, ‘বিদায় দে মা আবার ঘুরে আসি।’ আবার ঘুরে আসি।

স্পিকারকে উদ্দেশ করে চুন্নু বলেন, আপনার সঙ্গে আমার একাধিক সম্পর্ক। একটি হচ্ছে এই সংসদে আপনি আমার স্পিকার। আরেকটা হচ্ছে আপনি আমার এলাকার বউমা। আমার আগের স্পিকার ছিলেন আমার এলাকার জামাতা। দুই জন স্পিকারের শ্বশুরবাড়ি আমার এলাকায়। এটা অনেক বড় বিষয়। আপনি আর আমি দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের স্টুডেন্ট। আমি টেনেটুনে পাস করা। আপনি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। অক্সফোর্ডের পিএইচডি করা। ঢাবির ছাত্র হিসেবে আমরা আপনাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। আপনি সফল স্পিকার, আপনার জন্য দোয়া করি।

সংসদ নেতা আমাদের দেখালেন : জাতীয় পার্টি সংসদে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে দাবি করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। আমরাও সংসদে অপজিশন। আমি মনে করি, বিরোধী দলের এমপিরা আমরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেছি। এমন কোনও বিল নেই, যেটা নিয়ে আলোচনা করিনি। জনগণের স্বার্থে এমন কোনও ইস্যু নেই, যেটা নিয়ে কথা বলিনি। প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনাও আমরা করতে পেরেছি। কোনোরকম বাধা পাইনি। আমাদের ভূমিকাটি ছিল সন্তুষ্টির জায়গা।

দলটির এমপি রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, আমরা জানি না ভবিষ্যতে কারা আসবেন। ইলেকশন হবে। জানি না কারা আয় (আসে)। আল্লাহ যাকে লিখে রাখছেন তারা আসবে। ক্ষমতা দেওয়ার মালিক আল্লাহ। সম্মান দেওয়ার মালিক আল্লাহ। এ জন্য হতাশার কোনও কারণ নেই।

পীর ফজলুর রহমান বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীসহ বর্ণাঢ্য ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি। শেষ দিনের শেষ কার্যদিবস। কথা বলার অবারিত সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আমরা বারবার কথা বলেছি। মানুষের স্বার্থে কথা বলেছি। কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করার জন্য কথা বলিনি। কোনও মন্ত্রী থেকে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের জন্য কথা বলিনি। যাইনি।

জাতীয় পার্টির রওশন আরা মান্নান বলেন, দুই বছর করোনার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। তিন বছর আমরা তেমন কোনও কাজ করতে পারিনি। এ বিষয়টি যেন প্রধানমন্ত্রী স্মরণে রাখেন। পরে দলটির আরেক সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, উনি পরোক্ষভাবে সংসদের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলতে চাচ্ছেন।

স্পিকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনি সুন্দরভাবে সংসদ চালিয়েছেন। বিদেশে সম্মেলনে গিয়েছি। সব কিছু মিলিয়ে আমরা এই সংসদে ছিলাম। আবার কবে, আসতে পারি কিনা জানি না। হয়তো দেখা এত বড় জায়গায় আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউ আসতে পারে না। হয়তো অন্য কোথাও দেখা হবে। আজকে আমাদের শেষ সংসদ। আবার আসতে পারবো কিনা জানি না। আমরা কোনও ভুলত্রুটি করলে ক্ষমা করবেন। আপনাকে কখনও ভুলতে পারবো না। সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা আমরা একসঙ্গে ছিলাম। আবার একসঙ্গে কবে হবো আল্লাহ জানেন।

রওশন আরা মান্নানের বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, আমাদের সংসদ সদস্য রওশন আরা মান্নান বললেন, দুই-তিন বছর নষ্ট হয়ে গেছে। উনি পরোক্ষভাবে সংসদের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলতে চাচ্ছেন। আমি যেটা বুঝেছি। উনি পরোক্ষভাবে বলেছেন, আমি সোজা মানুষ তো, তাই সোজাভাবে বললাম। একটু বিবেচনা করে দেখতে পারেন।

শামীম হায়দার বিলের সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে বলেন, বিগত ৫ বছর এই সংসদে ছিলাম। অসংখ্য মিনিট আমরা কথা বলেছি। আপনি সুযোগ দিয়েছেন অত্যন্ত সুন্দর ও ফেয়ারলি। অনেকের বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছি এবং কঠোরভাবে সমালোচনা করেছি। সবাই তা শুনেছেন। কখনও উগ্র ভাষায় জবাব দেননি। এটা আমাদের দায়িত্ব ছিল। দেশের কিছু স্বার্থও এর মধ্য দিয়ে আমরা করেছি। আপনি আমাদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহাশীষ।

তিনি বলেন, আজকে এই সংসদ অধিবেশনের হয়তো বা শেষ দিন হতে পারে। এ জন্য সবার কাছে দোয়াও চাচ্ছি। জুনিয়র সংসদ সদস্য হিসেবে অনেক কথা বলেছি। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারেন। এজন্য ক্ষমাও চাচ্ছি। তবে আমরা জনগণের জন্য কথা বলেছি।

২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে একাদশ জাতীয় সংসদ। এ হিসাবে চলতি সংসদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৯ জানুয়ারি। সংসদের মেয়াদ আরও তিন মাসের মতো থাকলেও অধিবেশন আর বসছে না। সংবিধান অনুযায়ী, ৬০ দিনের মধ্যে সংসদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে, সংসদ নির্বাচনের স্বার্থে মেয়াদের শেষ ৯০ দিনের মধ্যে এই বিধানটি সংবিধানেই শিথিল করা হয়েছে। গত ১ নভেম্বর থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৯০ দিনের কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.