কূটনীতিকদের ওপর হামলার আশঙ্কা, বিশেষ নজরদারিতে ১৯ জেলা

প্রশান্তি ডেক্স ॥ বিদেশি কূটনীতিক এবং তাদের আবাসস্থলের ওপর হামলা করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সম্প্রতি পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ডাকা অবরোধকে কেন্দ্র করে ডিএমপি কমিশনারের কাছে পাঠানো এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এই আশঙ্কা করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এসবির প্রধান অতিরিক্ত আইজি মনিরুল ইসলামের সই করা ওই প্রতিবেদনে কূটনীতিকদের আবাসস্থল ও কূটনীতিকদের ওপর হামলার আশঙ্কা ছাড়াও বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা চলমান অবরোধ ও হরতালের নামে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে জানিয়ে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর করণীয় সম্পর্কেও সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপির বেশিরভাগ শীর্ষ নেতা গ্রেফতার হলেও পরবর্তী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তৃণমূল নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা ও নেতৃত্ব দিয়ে রাজপথে থেকে আন্দোলন সফল করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে পারে। বিএনপি-জামায়াত জোট ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বানচাল ও প্রতিহত করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংস কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। তারা হরতাল-অবরোধ দিয়ে আন্দোলনের নামে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, পুলিশের ওপর হামলা, পুলিশের অস্ত্র ছিনতাই, নির্বাচনি ও রাজনৈতিক কার্যালয় ভাংচুর, রেল ও নৌপথে নাশকতা, ককটেল বিস্ফোরণ ও গাড়িতে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করে। এবারও তারা আন্দোলনে সফল না হলে একই ধরনের পথ অবলম্বন করে দেশে সহিংস ও নাশকতামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটানোর চেষ্টা চালাতে পারে।

এসবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অবরোধ কর্মসূচি পালনকালে বিএনপি-জামায়াতের উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ কেপিআই স্থাপনা বঙ্গভবন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদ ভবন, সচিবালয়, সুধা সদন, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণকেন্দ্র, বিদেশি দূতাবাস, মন্ত্রীদের বাসভবন, সাবমেরিন ক্যাবলস, রেলস্টেশন, বাস ডিপো, ফ্লাইওভার, নৌ-টার্মিনাল, পেট্রোল পাম্প, সিএনজি স্টেশন, সরকারি বা বেসরকারি অফিস, ব্যাংক ও গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নাশকতামূলক কর্মকান্ড চালানোর আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া যান চলাচল বিঘ্ন করতে সড়কের বেইলি ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস, লঞ্চ-স্টিমার-ফেরি ইত্যাদি নৌযানে আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগ করতে পারে।

একইসঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের উচ্ছৃঙ্খল কর্মীরা সকালে বা ভোরে, সন্ধ্যায় অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি এলাকায় গণপরিবহন, বাস, পণ্যবাহী ট্রাক, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, কাভার্ড ভ্যান এবং পুলিশ বক্স ও পুলিশের টহল গাড়িতে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক-মহাসড়কে রাস্তার পাশের গাছ কেটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালাতে পারে। রেলগাড়িতে হামলা, রেলের ি¯্লপার ও ফিসপ্লেট উৎপাটন, রেলওয়ের বগি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটাতে পারে। ইতোমধ্যে গত ১ নভেম্বর পাবনার ঈশ্বরদী ও গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ট্রেন লক্ষ্য করে বোতলভর্তি পেট্রোল জাতীয় পদার্থসহ ককটেল নিক্ষেপ ও পাথর ছোড়া হয়েছে।

পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, তফসিল ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় এখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আগের চেয়ে আরও বেশি মারমুখী অবস্থান নেবে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও সবসময় যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ঢাকার বাইরের পাশাপাশি ঢাকাতেও নাশকতার শঙ্কা বেড়েছে। আমাদের দিক থেকেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবরোধ ও হরতালকারীরা চা, পান বিক্রেতা, আইসক্রিম বিক্রেতা বা অন্য যেকোনও হকারের ছদ্মবেশে যানবাহনে উঠে অগ্নিসংযোগসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রবেশ করে বোমা হামলা চালিয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে। আবার পুলিশ সদস্যরা সারা রাত ডিউটি করে ভোরবেলা ঘুমন্ত অবস্থায় থাকলে, দুপুরে খাবার খাওয়ার সময় বা সন্ধ্যায় ডিউটির পালা পরিবর্তনের সময় চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পুলিশ সদস্যদের হতাহত করে অস্ত্র-গুলি ছিনতাই করতে পারে।

১৯ জেলায় বিশেষ নজরদারির তাগিদ : আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির চলমান অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচিতে বেশ কয়েকটি জেলায় ব্যাপক সহিংসতার আশঙ্কা করছে পুলিশ। এসব জেলায় বিএনপি সাংগঠনিকভাবে একাই শক্তিশালী। এই জেলাগুলো ছাড়াও রাজধানীর ১০টি স্থানেও এ ধরনের তান্ডব চালানোর শঙ্কা করছে পুলিশ।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপি এককভাবে ১৯টি জেলা ও একটি মহানগরে সাংগঠনিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী। এগুলো হলো-মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা, চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, রাজশাহী, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, ঝিনাইদহ, যশোর, কুষ্টিয়া, বরিশাল, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও গাইবান্ধা। এসব জায়গায় তারা ২০১৩-২০১৪ সালে হরতাল-অবরোধের সময় ব্যাপক তান্ডব চালিয়েছিল। আগামী দিনের অবরোধ কর্মসূচিতেও এসব জেলায় ব্যাপক সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে।

একইভাবে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগরীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং পুলিশের উপস্থিতি কম রয়েছে ও ঘটনাস্থল থেকেও দ্রুত সরে পড়া যায়-এমন ১০টি স্থানে নাশকতার শঙ্কা করা হয়েছে। রাজধানীর এই এলাকাগুলো হচ্ছে-মাতুয়াইল, শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, মেরাদিয়া, দক্ষিণ খান, ভাটারা, মিরপুর, পল্লবী, খিলক্ষেত থেকে বিমানবন্দর সড়ক এলাকা।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সুপারিশে সারা দেশসহ ১৯টি জেলায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের সতর্কতাসহ সর্বদা প্রস্তুত থাকার পাশাপাশি আপৎকালীন রিজার্ভ ফোর্স স্ট্যান্ডবাই রাখতে বলা হয়েছে।

সার্বিক নিরাপত্তার জন্য পুলিশের পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (অপারেশনস) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘চলমান অবরোধ-হরতালকে ঘিরে পুলিশের সব ইউনিটকে সর্বোচ্চ সতর্ক থেকে জনগণের জানমাল রক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু জায়গায় বিশেষ নজরদারি ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.