গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে দূরত্ব বাড়ছে বাইডেন ও নেতানিয়াহুর

প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের বিরুদ্ধে কীভাবে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হবে এবং গাজার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হচ্ছে। যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিরোধের ইঙ্গিত বলে মনে করা হচ্ছে। বর্তমান ও সাবেক মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে এমন আভাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজ।

গাজার হাসপাতালগুলোতে ভয়াবহ পরিস্থিতি, নিহত বেসামরিক মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকায় হতাশ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা একাধিকবার নেতানিয়াহু ও তার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের সুরক্ষা এবং আরও মানবিক ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য।

এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হয়তো সম্ভাব্য সব কিছু করছে না তারা, এ জন্য আমরা উদ্বিগ্ন।

এই কর্মকর্তার ওই মন্তব্য যখন প্রকাশিত হয়েছে তখন গাজার বৃহত্তম আল-শিফা হাসপাতালে প্রবেশ করেছে ইসরায়েলি সেনারা। তাদের দাবি, হামাস যোদ্ধারা হাসপাতালের ভূগর্ভে কমান্ড সেন্টার পরিচালনা করছে।

বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, দুই সরকারের মধ্যে বিরোধের প্রধান বিষয় হলো ইসরায়েলের সামরিক অভিযান শেষে কে ফিলিস্তিনি ছিটমহলটি শাসন করবে। এখানে পশ্চিম তীরের শাসকগোষ্ঠী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ভূমিকাও রয়েছে। এতে জড়িয়ে আছে সংঘাত অবসানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্বিরাষ্ট্রনীতি সমাধান বাস্তবায়ন করা।

এক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, এক বা দুই মাস পর আমরা কোন পরিস্থিতিতে যেতে যাচ্ছি তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে।

দুই দেশ প্রকাশ্যে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করলেও গত সপ্তাহে ভিন্নমতের বিষয়টি সামনে এসেছে। ওই সময় নেতানিয়াহু বলেছিলেন, অনির্দিষ্টকালের জন্য গাজার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে ইসরায়েল।

নেতানিয়াহুর এমন মন্তব্যের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বিরোধিতা করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, গাজা উপত্যকায় কোনও ধরনের পুনর্দখল বা ছিটমহলে অবরোধের পরামর্শ গ্রহণ করবে না যুক্তরাষ্ট্র।

জাপানের টোকিও সফরে ব্লিঙ্কেন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে সংঘাতের পর গাজায় কোনও পুনর্দখল, অবরোধ বা ঘেরাও এবং গাজার ভূখন্ড কমবে না।

গাজার ভবিষ্যৎ নিয়েও মার্কিন পরিকল্পনা হাজির করেছেন ব্লিঙ্কেন। তিনি বলেছেন, গাজায় অবশ্যই ফিলিস্তিনিদের নেতৃত্বে শাসনব্যবস্থা থাকতে হবে এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের অধীনে গাজা ও পশ্চিম তীরকে একীভূত করতে হবে।

গাজা থেকে হামাস দ্বারা উৎখাত হওয়া ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলের দখলে থাকা পশ্চিম তীরে কিছুটা প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অপর পরাশক্তিগুলো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু হামাসের বিকল্প হওয়ার মতো জনসমর্থন তাদের নেই। হামাসকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে।

ব্লিঙ্কেনের প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়েছেন নেতানিয়াহু। এনবিসি’র ‘মিট  দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে  তিনি বলেছেন, গাজাকে নিরস্ত্রীকরণ ও সন্ত্রাসমুক্ত করতে হবে। কিন্তু ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষসহ কোনও ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর পক্ষে তা সম্ভব নয়।

ব্লিঙ্কেন ও নেতানিয়াহুর পাল্টাপাল্টি বক্তব্য তুলে ধরছে দুই দেশ গাজার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে কতটা জটিলতা রয়েছে।

ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি থিংক ট্যাংকের ম্যাথিউ লেভিট বলেছেন, সামরিক অভিযান শেষ হওয়ার পর গাজার জন্য একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা ইসরায়েল সামনে নিয়ে আসবে বলে অপেক্ষা করছে মার্কিন প্রশাসন।  লেভিট বলেন, আমার মনে হয় আরও বেশি কিছু করা হয়নি বলে এবং পরে কী হবে তা নিয়ে এক ধরনের হতাশা রয়েছে।

ইসরায়েল ও বাইডেন প্রশাসনের মধ্যে এই দূরত্ব আগামী মাসগুলোতে আরও বিস্তৃত হতে পারে। নেতানিয়াহু সরকারের ডানপন্থি সদস্যরা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করে আসছেন।

মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউট থিংকট্যাংকের গেরাল্ড ফেইরস্টেইন বলেছেন, এমন কিছু ইসরায়েল সরকার চাইবে না। কারণ, তারা গাজাকে পশ্চিম তীর থেকে আলাদা হিসেবে রাখতে চায়। এতে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি সামনে আসবে না। এটি নিয়ে বিরোধ দেখা দিতে পারে।

সাবেক ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের আরেকটি প্রস্তাব নিয়েও উদ্বিগ্ন বাইডেন প্রশাসন। ভবিষ্যতে গাজা থেকে ইসরায়েলে হামলা ঠেকাতে উত্তর গাজায় একটি সুরক্ষিত ‘বাফার জোন’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছেন সাবেক কর্মকর্তারা। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেত তাদের একজন।

এমন প্রস্তাব বাস্তবায়নে ফিলিস্তিনি ভূখন্ড দখল করা হবে কিনা প্রশ্নের জবাবে বেনেত বলেছেন, যখন নিরপরাধ বেসামরিককে কেউ হত্যা করে, তখন তাকে মূল্য দিতে হয়। আমরা ভূমি দখল করতে চাই বলে এটি করছি না। আমাদের এমন কোনও লক্ষ্য নেই। কিন্তু আমাদের জনগণকে তো রক্ষা করতে হবে।

কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস থিংকট্যাংকের মানবাধিকার আইনজীবী জাহা হাসান বলেছেন, এমন প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হবে। কারণ, কার্যত এর মাধ্যমে গাজার ভূখন্ড ইসরায়েলে একীভূত করা হবে।

২০১১ ও ২০১২ সালে শান্তি আলোচনায় ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদলে থাকা এই আইনজীবী বলেন, এটি আইনসম্মত নয় এবং নৈতিকভাবেও মেনে নেওয়া যায় না। মানবিকতার খাতিরে তো একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারাও বলছেন, গাজায় ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত বাফার জোনের অর্থ হবে ছিটমহলের ভূখন্ড কমে যাওয়া, যা অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করে হোয়াইট হাউজ।

দ্বিতীয় এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের একটি নীতি রয়েছে, তা হলো গাজায় কোনও ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত হওয়া উচিত না। বাফার জোনকে আমরা সঠিক উপায় বলে মনে করি না।পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেটেলারদের দ্বারা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার বিষয়েও বাইডেন প্রশাসন উদ্বেগ জানিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, চলতি মাসের শুরুতে নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকে এসব ঘটনা অগ্রহণযোগ্য বলে তুলে ধরেছেন ব্লিঙ্কেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.