ইসরায়েলের পক্ষপাতে বাইডেন হারাচ্ছেন তরুণ ভোটারদের

প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ হামাস-ইসরায়েল সংঘাত মোকাবিলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পদক্ষেপ ও অবস্থান নিয়ে তার নিজ দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে বিভাজন ক্রমশ বাড়ছে। পুনরায় নির্বাচিত হতে আগ্রহী ৮১ বছর বয়সী নেতার জন্য এটি একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে হাজির হচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা কমছে। একই সঙ্গে দলের ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য হিল-এর এক প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে।

ডেমোক্র্যাটিক কৌশলবিদ ও প্রগতিশীল অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, যুদ্ধ ও ফিলিস্তিনি বেসামরিক হতাহতের চিত্র নিয়ে উদারপন্থি, বিশেষ করে তরুণ ডেমোক্র্যাট এবং সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক ভোটবাক্সের ক্ষতি করতে পারে।

একাধিক প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর হয়ে কাজ করা ডেমোক্র্যাটিক কৌশলবিদ ট্যাড ডেভাইন বলেন, সমর্থনকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতাশ হয়ে গেলে আমি এটিকে একটি প্রকৃত সমস্যা মনে করবো। আমি মনে করি তরুণদের মধ্যে যা ঘটছে এবং ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যে যা ঘটছে, তা একটি সমস্যা।

তিনি বলেন, এই সমস্যা কত বড়? যদি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন হয় তাহলে একটি বড় সমস্যা। সৌভাগ্যবশত নির্বাচনের এখনও ১১ মাস দেরি আছে। আমি মনে করি, শুধু ইসরায়েল ইস্যু নিয়ে নয়, বেশ কিছু ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসনের অনেক উন্নতির সুযোগ আছে।

মার্কিন প্রশাসনের চাপের মুখে গত বুধবার ইসরায়েল ও হামাস জিম্মি ও লড়াইয়ে বিরতির সমঝোতায় বাইডেন একটি জয় পেয়েছেন। এই সমঝোতায় হামাসের হাতে থাকা ৫০ জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে ইসরায়েল চার দিন লড়াই বন্ধ রাখবে এবং ১৫০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে। ইসরায়েলি সরকার বলেছে, আরও জিম্মি মুক্তি দেওয়া হলে বিরতির মেয়াদ বাড়তে পারে। গত শুক্রবার থেকে এই বিরতি কার্যকর হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কিন্তু মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজের পরিচালিত এক জনমত জরিপের ফল অনুসারে, ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সী ভোটারদের মধ্যে ৭০ শতাংশ বাইডেনের যুদ্ধ নিয়ে পদক্ষেপকে সমর্থন করেন না। ১ হাজার নিবন্ধিত ভোটারদের মধ্যে হার্ট রিসার্চ অ্যাসোসিয়েটস অ্যান্ড পাবলিক অপিনিয়ন স্ট্র্যাটেজিস এই জরিপ পরিচালনা করে। সামগ্রিকভাবে ৫১ শতাংশ বাইডেনের পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।

সংঘাত যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে ডেমোক্র্যাটিক দলের ভেতরে বিভাজন ক্রমশ বাড়ছে। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের একমাত্র ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সদস্য রাশিদা তালেবকে সমর্থন করেছেন ২২ জন ডেমোক্র্যাটিক সদস্য। তারা গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।

এছাড়া গত সপ্তাহেই ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদর দফতরের সামনে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সহিংস সংঘর্ষ হয়। গত শনিবার গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবিতে বিপুল মানুষের বিক্ষোভে ক্যালিফোর্নিয়ায় ডেমোক্র্যাটিক কনভেনশন বেশ কয়েক ঘণ্টা বন্ধ ছিল।

বাইডেন দৃঢ়তার সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে আসছেন। ১৮ নভেম্বর ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা একটি নিবন্ধে তিনি পুনরায় ইসরায়েলের প্রতিরক্ষার অধিকারের ওপর জোর দিয়েছেন।

কৌশলবিদরা বলছেন, এই সংঘাত বাইডেনের জন্য একাধিক বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে। প্রথমত, যুদ্ধবিরতির পক্ষে বাইডেনের আহ্বান জানাতে অস্বীকৃতি প্রগতিশীলদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। এই ইস্যুতে ইতোমধ্যে দুই ডেমোক্র্যাট সিনেটর বাইডেনের কাছ থেকে  দূরে সরে গেছেন। এদের একজন হলেন সিনেটে ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা হুইপ ডিক ডারবিন। অপরজন হলেন সিনেটর জেফ মার্কলি।

এছাড়া প্রতিনিধি পরিষদের ৪০ জনের বেশি ডেমোক্র্যাট সদস্য যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য রো খান্না প্রথমদিকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানানোর পর তার কার্যালয়ে ঢুকে পড়েছিল একদল অ্যাক্টিভিস্ট। পরে তিনি স্বাক্ষর দিতে রাজি হন।

দ্বিতীয়ত, বাইডেন ধৈর্যধারণের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। কিন্তু তার এই আহ্বান মোটাদাগে উপেক্ষা করে যাচ্ছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এর ফলে সহিংসতা কমাতে ব্যর্থ হলে বাইডেন দুর্বল বলে ভাবমূর্তি তৈরি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

সংঘাত যত দীর্ঘায়িত হবে, বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার হুমকি তত বাড়বে। তখন বাইডেন বিভিন্ন রাজনৈতিক জটিলতার মুখোমুখি হতে বাধ্য হবেন।

চলতি সপ্তাহে ইসরায়েলের একটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলার দায় স্বীকার করেছে লেবাননের ইরানপন্থি শিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। ৭ অক্টোবরের পর থেকে নিয়মিত ইসরায়েলের সঙ্গে লেবানন সীমান্তে পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণ হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এসব খন্ড যুদ্ধ সীমিত পর্যায়ে ঘটছে। তবে আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে, গাজায় চলমান সংঘাতে ইরানপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো যেকোনও সময় জড়িয়ে পড়তে পারে।

গত বুধবার ইরাকে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের অবস্থানে দ্বিতীয়বারের মতো হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব মিলিশিয়ারা ইরাকে মার্কিন ও জোট সেনাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে।

শীর্ষস্থানীয় প্রগতিশীল অ্যাক্টিভিস্ট ও ক্যাম্পেইন ফর আমেরিকা’স ফিউচার-এর সহ-পরিচালক বব বরোসাজ বলেন, যদি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয় এবং ইসরায়েল নিজেদের ধারা অব্যাহত রাখে, তাহলে বিরোধিতা বাড়বে, এখানকার বিভাজন বাড়বে, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে। বিশ্বজুড়ে সমালোচনা ও নিন্দা বাড়বে এবং যুদ্ধ নীরবে বিস্তৃত হতে পারে। ফলে আমি মনে করি, প্রশাসনের এটি একটি বড় সমস্যা।

তিনি বলেছেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে ধৈর্য দেখিয়ে বেসামরিকদের হতাহত কমিয়ে আনতে আহ্বান জানিয়েছেন বাইডেন। একই সঙ্গে পশ্চিম তীর ও গাজার শাসনভার ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু নেতানিয়াহু ও তার মিত্রদের ওপর এসব অনুরোধের প্রভাব খুব কম পড়ছে।

বব বরোসাজ বলেন, যা ঘটেছে তা হলো বাইডেনের কথা উড়িয়ে দিয়েছেন নেতানিয়াহু। ইসরায়েলি নেতা বলেছেন, যুদ্ধের পর গাজা শাসন করবে তার দেশ। দুই নেতার এই ভিন্ন অবস্থান বলে দিচ্ছে যে বাস্তবতা হলো ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অর্থ নিচ্ছে এবং তারা বাইডেনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্‌ন করার জন্য যা করতে চায় তা করছে।

তিনি আরও বলেছেন, দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বাইডেনের উচিত সংঘাত এবং বোমা বিস্ফোরণে আহত বেসামরিকদের বির প্রবাহ দ্রুত কমানো।

তার কথায়, নেতানিয়াহুকে মার্কিন প্রশাসনের আলিঙ্গন করা এবং কোনও চাপ ছাড়া প্রথমে একান্তে ও পরে প্রকাশ্যে ধৈর্যধারণের আহ্বান জানানো একটি ভুল।

ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের এক সিনিয়র ফেলো ড্যারেল ওয়েস্ট স্বীকার করেছেন, প্রগতিশীল ও তরুণ ভোটারদের মধ্যে বাইডেনকে নিয়ে জটিলতা রয়েছে। কিন্তু তিনি ধারণা করছেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান প্রার্থী হলে এই ভোটাররা বাইডেনকে সমর্থন করবেন। বাইডেন ও ট্রাম্পের পার্থক্যের কারণে ডেমোক্র্যাট শিবিরে শামিল হবেন ভোটাররা। সূত্র: দ্য হিল

Leave a Reply

Your email address will not be published.